রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১৬)


একটা চেনা কণ্ঠ শুনতেই নম্রতা পেছন ফিরে তাকায়। দেখে বাইক নিয়ে শান দাঁড়িয়ে। বাইক টাকে সাইড করে নম্রতার সামনে এসে বললো,
---------হায় নম্রতা।
নম্রতা ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেয়,
---------হ্যালো।
তারপর হাতঘড়িতে চোখ নিবদ্ধ করে। শান একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। নম্রতার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা আর কি! নম্রতা হাতঘড়ির থেকে চোখ তুলে শানের দিকে তাকায়। শান দায়সারাভাবে হাসে একটু।
---------কোথায় যাবেন?
শানের প্রশ্ন।
নম্রতা উত্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
----------ভার্সিটি। আজকে এক্সাম আছে। ঘুম থেকে উঠতে লেইট হওয়ায় ভার্সিটির বাস মিস করছি। এখন লোকাল বাসের অপেক্ষায় আছি অথচ দেখুন না,কোনো খবর নেই বাসের!
শান ও উত্তর দিকে তাকিয়ে বলে,
---------হুম তাই তো দেখা যায়। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?
এবার নম্রতা শানের দিকে তাকায়। একদম চোখের দিকে। শানের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠে। এতটা শান্ত চাহনির কোনো মেয়েকে তার এই প্রথম দেখা!
নম্রতা মৃদু গলায় বলে,
----------হুম বলুন।
শান নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
----------নদীর পাড়ে আসেন না যে!
----------ওহ! আসলে টাইম পাই না। আবার জব শেষে বাসায় গিয়ে স্টাডি করতে হয়। এক্সাম তো!
শান বুঝ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
--------ওহ আচ্ছা।
অথচ তার মন বলছে এই কারনে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশ উপভোগ করাটা মিস দেওয়ার মতো মেয়ে নম্রতা না। এর পেছনের কারন অন্য। কিন্তু সেটা কী! শান আর আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেনা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান বললো,
--------এক্সাম না মিস হয়ে যায় আপনার!
--------হুম। তাই তো মনে হচ্ছে।
নম্রতার কণ্ঠে স্পষ্ট চিন্তা।
শান নম্রতার কাছাকাছি আরেকটু সরে এসে বলে,
---------আপনি কিছু মনে না করলে আমার বাইকে আসতে পারেন। আমি আপনাকে পৌঁছে দি।
নম্রতা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় শানের দিকে। শান থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,
---------আপনার এক্সামের কথা ভেবেই বললাম!
নম্রতা চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে। এরপর শানের দিকে ফিরে বললো,
----------আচ্ছা চলুন।
শান প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশি হয়। বলে,
--------হুম আসুন।
শান বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দেয়। তার পেছনে চড়ে বসে নম্রতা। দুজনের মাঝে দূরত্ব আছে বেশ খানিকটা। তবুও যেন শানের শান্তি। এভাবে যদি সারাটা জীবন নম্রতাকে বাইকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতো!
ওরা বাইকে করে যাওয়ার সময় ব্যাপারটা জালাল শেখের নজরে পড়ে। সে কিঞ্চিৎ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। ভাবতে থাকে ছেলেটার কথা। তার ছেলের হবু বউ অন্য এক ছেলের বাইকের পেছনে। ব্যাপারটা মোটেও শোভনীয় নয়। জালাল শেখ মনে মনে ভাবেন,এই ব্যাপারটা তাকে একটু ঘেটে দেখতে হবে।
.
.
ফোন বাজতেই নিশুতি প্রায়াণ কে উদ্দেশ্য করে বললো,
---------আমি ফোনের কাছে যাচ্ছি। ভালো ভাবে কাপড় গুলো ধোয়া চাই। নাইলে আবার ধোয়াবো কিন্তু...
প্রায়াণ উত্তরে একটা মুখ ভেংচি ছুড়ে দেয় নিশুতির পানে। নিশুতি সেটা দেখেও এড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবে,ইফতির ফোন নিশ্চয়ই। কিন্তু না,তার কাকা নাসির হোসেনের ফোনকল।
নিশুতি বারান্দায় গিয়ে ফোন রিসিভ করে।
--------আসসালামু ওয়ালাইকুম কাকা।
---------ওয়ালাইকুম আসসালাম।।কেমন আছো মা?
---------আলহামদুলিল্লাহ কাকা। ভালোই আছি।
---------টাকা পয়সা লাগবে কিছু?
---------নাহ লাগবেনা কাকা।
নিশুতি মনে মনে বলে,তোমার দেওয়া ১০ হাজার টাকার পুরোটা এখনো আমার কাছে আছে। একটা টাকাও খরচ করতে দেয়নি প্রায়াণ।
---------হ্যালো নিশু মা।
নিশুতি সম্বিত ফিরে পায়।
দ্রুত বললো,
----------হ্যাঁ কাকা শুনছি তো। বলেন।
-----------এদিক টা নর্মাল হয়ে গেছে একদমই। তুমি চাইলে এখন ফিরে আসতে পারো। মেয়ে মানুষ একা একা আর কতদিন থাকবা এত দূরে!
নিমিষেই নিশুতির মনটা ছোট হয়ে যায়। ফিরে যাওয়া! মানে প্রায়াণের থেকে আবার দূরে চলে যাওয়া! এই কয়দিন প্রায়াণের সাথে থাকতে থাকতে, তাকে ছাড়া বা তার থেকে দূরে থাকাটা নিশুতির মন মানতে চাইছে না কিছুতেই।
---------হ্যালো! কিছু বলছিস না কেনো নিশু?
নিশুতি হালকা কণ্ঠে বললো,
---------হুম আসবো কাকা।
---------তাহলে আজ কালকের ভেতরেই চলে আয়।
--------আচ্ছা।
--------রাখছি মা। ভালো থাক।
নিশুতি আর বায় বলে না। ফোনের লাইন কেটে দেয়। ইতিমধ্যে প্রায়াণের কাপড় ধোয়া শেষ হয়। সে ধোয়া কাপড় গুলো চিপে বালতিতে করে বারান্দায় নিয়ে আসে। একটা একটা করে ঝাড়ছে আর দড়িতে নাড়ছে। নিশুতি বারান্দার গ্রিলের উপর থুতনি রেখে উদাসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
সব কয়টা কাপড় নাড়তে দেওয়া শেষে প্রায়াণের নজর পড়ে নিশুতির উপর। সে সেন্টু গেঞ্জির এক কোণায় হাত মুছতে মুছতে নিশুতির পাশে এসে দাড়ায়। চিন্তিত হয়ে বলে,
---------কি? এখনো রাগ কমেনি আমার উপর? মন খারাপ করে আছো যে!
নিশুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে বলে,
---------কাকা ফোন দিয়েছিল। বললো আজ কালকের ভেতরেই ঢাকা চলে যেতে।
কথাটা শুনে নিশুতির থেকেও বেশি কষ্ট হয় প্রায়াণের ভেতরে। এত তাড়াতাড়ি তাদের এই লাভিং জার্নি টা শেষ হয়ে যাবে নাকি!
প্রায়াণ নিজের দুমড়ে মুচড়ে উঠা হৃদয়ের কথা নিশুতির কাছে প্রকাশ করে না। দায়সারাভাবে বললো,
--------তুমি কি বললা?
--------বলেছি যে আচ্ছা।
--------ওহ!
প্রায়াণের কিছু বলার মতো নেই আর। আজ হোক বা কাল,একদিন তো যেতেই হবে তাদের ঢাকা ফিরে। তখন হয়তো সম্পর্ক থাকবে,কিন্তু এভাবে না। এতো কাছাকাছি পাশাপাশির সম্পর্ক হয়তো থাকবে না। আর ভবিষ্যতে হবে কী না তার কী নিশ্চয়তা?
প্রায়াণ বারান্দা থেকে ভেতরের রুমে আসে। ডিভানের উপর থাকা পানির বোতল নিয়ে কিছু পানি খায়। তারপর বোতল হাতেই বিছানার উপর বসে। নিশুতি বিছানার পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। পা দিয়ে টাইলসে খোচাচ্ছে। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে উঠে।
দৌড়ে প্রায়াণের সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে বললো,
--------দুদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই না চলুন! ইফতিকে বলি? ও কাকাকে রাজী করিয়ে ফেলবে পাক্কা। এরপর দুটোদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই?
প্রায়াণের ভালো লাগে আইডিয়াটা। উল্লাসিত গলায় বললো,
---------হুম ঘুরা তো যায়ই। আর এতো সুন্দর জায়গায় এসেছো অথচ ঘুরবা না! কেমন না?
নিশুতি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,
--------হুম হুম। আমি এক্ষুনি ইফতিকে ফোন করছি।
.
ইফতি সবেমাত্র সকালের নাস্তা সেরে ছাদে উঠেছে স্নুপিকে নিয়ে। নিশুতি আর প্রায়াণের অবর্তমানে সেই স্নুপির মালিক। ঠিক এমন সময় নিশুতির ফোন।
---------হ্যাঁ বোন শুভ সকাল।
---------শুভ সকাল ভাই।।কি করিস।
---------ছাদে। হাটাহাটি।
---------ওহ শোন না। একটা কথা রাখবি?
---------আগে বল।
---------কাকা ফোন করে বললো আজ কালকের ভেতরেই চলে আসতে। আমি দুটোদিন সিলেট শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে চাই। সো তুই যদি একটু কাকাকে রাজী করাতি!এরকম সুযোগ তো বারবার আসবে না।
ইফতি গম্ভীর গলায় বললো,
--------প্রায়াণ ভাইয়ের সাথে ঘুরবি?
নিশুতি ইতস্তত করে বললো,
--------হুম।
ইফতি আর বাধা দিলো না। দায়সারাভাবে বললো,
---------ওকে। আমি কাকাকে বলবোনি।
নিশুতি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,
---------লাভ ইউ ব্রো। রাখি রে বায়।
নিশুতি ফোন রেখে দেয়। ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেই প্রায়াণের জন্য নিশুতির বাসা থেকে পালাতে হলো,সেই প্রায়াণকেই আজ নিশুতি ভালোবাসে। সেটা নিশুতি না বললেও, ইফতি স্পষ্ট বুঝতে পারছে।
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)