রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ২০)


প্রায়াণ নিশুতি সোফায় একদম পাশাপাশি বসে আছে। তাদের সামনা সামনি বসে আছে জালাল শেখ, মিনু শেখ, আজহার হোসেন, শারমিন হোসেন। প্রত্যুষ, পিউ,প্রেমা আর নম্রতাও আছে।
মিনু শেখ গমগমে গলায় বললো,
"তাহলে এই সেই মেয়ে যার জন্য তুই তোর পরিবারের কথা একবারো ভাবলি না? এই মেয়ে তুমি কি জাদু করেছো আমার ছেলের উপর?"
নিশুতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে তো কোনো জাদু টোনা করেনি প্রায়াণের উপর। ভালোবাসা কি জাদু দিয়ে হয়! কি অদ্ভুত!
নিশুতি চুপ করে থাকে। উত্তর দেয় প্রায়াণ,বেশ শান্ত স্বরে...
"মা ও আমার বিবাহিত স্ত্রী এখন। আমরা কাল সন্ধ্যায় বিয়ে করেছি।"
এই কথাটা শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না বোধহয়। মিনু শেখ অবিশ্বাস্য চোখে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। জালাল শেখ এর চোখে আগুন। শারমিন হোসেন বলে উঠে,
"দেখছো আমি আগেই বলছিলাম না এই ছেলের সাথে তোমার ডায়নী মেয়ের লটরপটর আছে। এখন দেখলা তো? আমার কথা ফললো তো?"
আজহার হোসেন বিব্রতবোধ করেন। ধমকের গলায় বললো,
"চুপ করবা? বেশি বকবক করো।"
শারমিন হোসেন একটা মুখ ভেংচি দিয়ে চুপসে গেলেন। প্রায়াণ আবারো বললো,
"ইচ্ছাকৃত ভাবে বিয়েটা করিনি। একটা ঝামেলায় পড়ে করা লাগছে। কিন্তু যখন হয়েই গেছে,আমি এখন মন থেকেই আমার স্ত্রী হিসেবে মানি।"
"যখন এতোই স্ত্রী হিসেবে মানো,তখন এখানে কেনো এসেছো? তুই আর তোর স্ত্রীর কোনো দরকার নেই আমাদের।"
মিনু শেখ এর কথায় প্রায়াণ আহত হয়। সে আগে থেকেই জানতো তার মা এরকম কিছুই বলবে। কিন্তু ইনডাইরেক্টলি যে বাসা থেকেও চলে যেতে বলবে সেটা ভাবেনি।
প্রায়াণ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও বাহিরে তা প্রকাশ করলো না। বেশ শান্ত গলাতেই বললো,
"বেশ। তাহলে আমরা চলেই যাই। চলো নিশুতি।"
নিশুতি অবাক চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ কি সত্যিই সব ছেড়ে তার হাত ধরবে!
ওরা দুজনে সোফা থেক উঠে দাড়ালে জালাল শেখ মুখ খুলেন।
ধমকে বসতে বলেন ওদের দুজন। নিশুতির ভয়ে আত্মা কেপে উঠে। সে চুপ করে বসে পড়ে আবার। প্রায়াণ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসে। তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা। জালাল শেখ আজহার হোসেন কে উদ্দেশ্য করে বলে,
"ছেলে মেয়ে যখন একটা ভুল করেই ফেলছে,আমরা তো সেই ভুল টাকে আরো টানতে পারিনা তাইনা?"
"জ্বি ভাই"
"আপনি কি রাজী আমার ছেলের সাথে আপনার মেয়েকে দিতে?"
আজহার হোসেন কিছু একটা ভাবেন। তারপর বললো,
"জ্বি রাজী।"
"আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আজ থেকে আপনার ঘরের মেয়ে,আমার ঘরেরও মেয়ে।"
আজহার হোসেন মুখে টেনে হাসির রেখা ফুটান।
পিউ থেমে থেমে নিঃশব্দে হাসতে থাকে। প্রেমা ফিসফিসিয়ে বলে,
"তুই হাসতেছিস ক্যান কুত্তি? আম্মু দেখলে বকবে।"
"কি করবো আমার অনেক হাসি পাচ্ছে যে! নইলে দেখো পরিস্থিতি টা।আমি যাকে মন থেকেই চাইতাম আমার ভাবী হোক,সেই হলো। হোক সেটা ছোট ভাইয়ের।"
"তুই নিশুতিকে ভাবী হিসেবে চাইতি?"
"তা নয়তো কী? কি সুন্দর আপুনি। কথাবার্তা চালচলন সবকিছুই আমার ভালো লাগে। নাচতেও পারে। আমাকে বলছিল একবার।আর আমি চাইবো না?"
"আর আমাক চাইতে না?"
নম্রতার কথায় প্রেমা পিউ দুজনেই তার দিকে তাকায়। তারা ভুলেই গেছিল নম্রতার কথা। নম্রতার চোখে পানি। অথচ মুখে হাসি। প্রেমা নিচু স্বরে বলে,
"সরি আপু।"
"ইটস ওকে।।তোমাদের তো আর কোনো ভুল নেই।"
"তবুও...!"
নম্রতা আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো,
"যে আমার ছিল না,তাকে হারাতেও বেশি কষ্ট লাগানো উচিত না।"
প্রেমা পিউ দুজনেই চুপ হয়ে যায়। তাদের তো কিছু বলার নেই এই জায়গায়।
মিনু শেখ রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে তার স্বামীর দিকে। কোনো খুশিতে সে এদের কে মেনে নিচ্ছে কে জানে! মনে মনে ভাবে,একবার সবাই যাক,এর ফল তাকে বোঝাবে।
আরো কিছু টুকটাক কথা বার্তা শেষে আজহার হোসেন ও শারমিন হোসেন নিজেদের বাসায় চলে যান।
বাসায় ঢুকতেই শারমিন হোসেন গর্জে উঠলো,
"তুমি ঐখানে মায়া দিবার লইগা রাজি হইয়া গেলা ক্যান?? মায়ার প্রতি এত দরদ উঠলো কবে থেইকা??"
"দরদ না দরদ না। বিনা খরচে মেয়ে বিদায় করেছি। এর থেকে বড় আর কী হয়?"
শারমিন হোসেন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
"তোমার যে এতো বুদ্ধি! আসলেই একটা ভালো কাজই করেছো।"
.
.
প্রায়াণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নিশুতি প্রেমা পিউর সাথে আছে। নম্রতা এই ফাকে বারান্দায় ঢুকে পড়ে।
হালকা গলায় ডাকে,
"প্রায়াণ।"
প্রায়াণ পিছন ফিরে নম্রতাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ।সত্যি বলতে এই মেয়ের তো কোনো দোষ ছিল না আদৌও। তাও শুধু শুধু তার কারনে কষ্ট পাচ্ছে!
প্রায়াণ ব্যথাতুর কণ্ঠে বলে,
"একচুয়ালি আমি তোমাকে কোনোদিনই ভালোবাসিনি নম্রতা। আমার মা আর তোমার মা চাইতো আমাদের বিয়ে হোক কিন্তু আমি তো তোমাকে একটা ফ্রেন্ড ছাড়া কখনো কিছু ভাবিনি। তবুও আ'ম সরি। আমার জন্য অনেক কষ্ট পেতে হচ্ছে তোমার।"
নম্রতা কিছু বললো না। আচমকাই ঝাপিয়ে পড়লো প্রায়াণের বুকে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো,
"কেনো এরকম করলে? আমার থেকেও ও বেশি সুন্দরী? যখন থেকে প্রেম ভালোবাসা কি জিনিস বুঝেছি তখন থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি। তোমাকে কখনো ভাই বা ফ্রেন্ড এর চোখে দেখিনি আমি। আমার স্বামীর রূপে দেখেছি। আর সেই তুমি কিভাবে পারলে এত বড় একটা কাজ করতে? একবারও আমার কথা মাথায় আসলো না?"
প্রায়াণ থতমত খায়। ঠেলে সরিয়ে দেয় নম্রতাকে। কঠিন গলায় বলে,
"প্লিজ নম্রতা। আমি তো তোমাকে বললাম যে আই ডোন্ট লাভ ইউ। আর কখনোই ভালোবাসিনি। না তোমাকে কোনো স্বপ্ন দেখিয়েছি! মা রা চাইলো,আর বিয়ে দিয়ে দিলো, এমন তো হবে না। বিয়ে মানে দুটো পরিবারেরই মিল না, দুটো মনেরও মিল আর সেই মিল আমি খুঁজে পেয়েছি নিশুতির সাথে। তোমার সাথে না নম্রতা। সো প্লিজ,আর এসব কথা বার্তা নিয়ে আমার কাছে আসবে না।আমার ভালো লাগেনা।"
প্রায়াণ দুম করে বারান্দা থেকে বেরিয়ে যেতেই দেখে মিনু শেখ দাঁড়িয়ে। প্রায়াণ তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। নম্রতা জানালার গ্রিল ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠে। তার পাশে আসে মিনু শেখ। নম্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
"আমি তোমাকে ছোট বেলা থেকে আমার ছেলের বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছি না? সেই স্বপ্ন আমিই পূরণ করবো। তুমি কেঁদো না মা।"
.
.
"বাবা আসবো?"
জালাল শেখ কঠিন গলায় বললো,
"আসো।"
প্রায়াণ কাচুমাচু হয়ে রুমে ঢোকে। অপরাধী ভঙ্গিতে তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কৈফিয়তের সুরে বলতে লাগে,
"আসলে বাবা। নিশুতি পালিয়ে যাচ্ছিল ওর বাসা থেকে। ওকে জোর করে বিয়ে দিবে তাই। তখন আমি ওকে দেখি তো তাই..."
"আমি তোমার থেকে এসব শুনতে চাইনি।"
প্রায়াণ চুপ হয়ে যায়। জালাল শেখ বলেন,
"তুমি আমাদের ছোট ছেলে। তুমি কি করেছো,ইচ্ছে করে নাকি ভুল করে নাকি কেনো করেছো আমি জানতে চাইনা। কিন্তু তোমাকে তো একদম ফেলে দিতে পারিনা। এলাকায় একটা সম্মান আছে আমাদের। সেই সম্মান টাও নষ্ট হতে দিতে পারিনা। সারা এলাকা খবরে তোমাকে আর নিশুতিকে দেখছে। এখন তারাও বলবে,তোমাদের বিয়ে দেওয়া উচিত। যেহেতু সেটা আগেই করে ফেলেছো তাই মেনে নেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।"
প্রায়াণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
"ধন্যবাদ বাবা।"
"এবার আসতে পারো।"
প্রায়াণ চুপ করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। নিশুতি কে অনেকক্ষণ যাবত দেখছে না,কোথায় মেয়েটা!
.
.
প্রায়াণের ঘরে বসে আছে নিশুতি। তাকে ঘিরে রেখেছে প্রেমা আর পিউ। দুজনের মুখেই হাসি। পিউ বলে,
"তুমি খুব ভালো ভাবী। তুমি আসলা আর আমার স্কুলে যাওয়া টা মিস করিয়ে দিলা। আজকে আর স্কুল যাওয়া হলো না।।কি আনন্দ!!"
নিশুতি মৃদু হাসে পিউর কথা শুনে। প্রেমা কপাল কুঁচকে বলে,
"চুপ কর। তুই আছিস তোর ফাকিবাজি নিয়ে। আচ্ছা তুই তো এখন থেকে আমার ভাবী হয়ে গেলি রে! তোকে ভাবী ভাবী করে ডাকতে ভীষণ বেগ পোহাতে হবে আমার৷ তবে অভ্যাস হয়ে যাবে ডোন্ট টেনশন।"
"তুই আমার ফ্রেন্ড ছিলি,ফ্রেন্ডই থাকবি। এসব ভাবী টাবি বলতে হবে না।"
"আর আমি কি বলবো?"
পিউ বলে উঠে।
"তোমার যেটা ইচ্ছা"
"আমি বেনে বৌ বলবো?"
প্রেমাও অবাক হয়। সাথে নিশুতিও।
নিশুতি বলে,
"বেনে বৌ কেনো?"
"কারন তুমি বেনে বৌ পাখির মতোই সুন্দরী। "
পিউর কথায় প্রেমা নিশুতি দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠে।
তখনি প্রায়াণ আসে।
"কি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে ননদ ভাবীর মধ্যে?"
"তোমাকে কেনো বলবো? এগুলা আমাদের পারসোনাল ব্যাপার। "
পিউর কথা শুনে ওর মাথায় গাট্টা মারে প্রায়াণ। বলে,
"হইছে। অনেক পারসোনাল ব্যাপার বলছিস। এখন বাহিরে যা। তোর ভাবীর সাথে আমার কথা আছে।"
পিউ মুখ বাকিয়ে বলে,
"রাতে যখন বাসর রাত হবে তোমাদের,তখন যত কথা বলার বলিও। এখন আমরা বলি। তুমি যাও।"
প্রায়াণ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। প্রেমা মুখ টিপেটিপে হাসে। অথচ নিশুতি, ধীরে ধীরে লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে।
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)