আমি নায়ক জসিম - আসাদুজ্জামান রাজ [ঠোট গল্প]


আমি নায়ক জসিম
__"আসাদুজ্জামান রাজ"
.
ভোর রাতে স্বপ্নে দেখলাম আমি নায়ক জসিম হয়ে গিয়েছি।
ঠেলাগাড়ি ঠেলছি। আদ্রিতা ঠেলাগাড়িতে বসে হাত তালি দিচ্ছে। মুখে বলছে,
‘ওস্তাদ, বামে প্লাস্টিক...’
কি বিচ্ছিরি স্বপ্ন! এমন স্বপ্নও বুঝি কোনো প্রেমিক দেখে। পরমুহূর্তেই স্বপ্ন পাল্টে গেল। দেখি, লটারি লেগেছে একটা। প্রথম ডিজিটগুলো মিলে যাচ্ছে। আমার বুক ধড়পড় করতে লাগলো। গা ছেড়ে ঘাম দিলো। শেষের দুই ডিজিট মেলানোর পরই তীব্র উত্তেজনায় ঘুম ভেঙ্গে গেল।
প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় মন তেঁতে উঠেছে ততক্ষণে। বারান্দায় এসে সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছিলো খুব। চুপিচুপি আব্বার রুমের আলমিরার ডান সাইডে লুকোনো বিশেষ ড্রয়ার থেকে আব্বার লুকানো বেনসনের প্যাকেট নিয়ে আসলাম। সিগারেট ধরিয়ে মনে মনে এপিজে আবদুল কালামের কালজয়ী লাইনগুলি ভাবলাম, স্বপ্ন ওটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন ওটাই যেটা তোমায় ঘুমাতে দেয়না।
আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আদ্রিতার গলার স্বর লেগে আছে কানে এখনো, লটারির শেষ তিন ডিজিট চোখে ভেসে উঠলো বারবার। ঘুম হলোনা।
সকালে আব্বাকে বললাম,
‘আব্বা, টাকা দাও। লটারির টিকেট কিনবো।’
আব্বা সকালবেলায় হাসিমুখে মশকরা করতে পছন্দ করেন। তিনি আদুরে স্বরে বললেন,
‘দেবো বাবা, বসো তুমি। বলো, ক্যাশ দেব না চেক?’
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপমান হজম করলাম। আব্বা মশকরা জারি রাখলেন। নৃত্যশিল্পী আজিজ রেজার মতো করে বললেন,
‘এটা তো অতি আনন্দের সংবাদ। জসিম হইছো তুমি। লটারি কিনবা, লটারি লেগে যাবে। তারপর তুমি বড়লোক হয়া যাবা। গুলশান উত্তরায় দুইটা করে চারটা ফ্লাট কিনবা। শাবানাকে বিয়া করবা।’
আব্বার কল্পনাশক্তি জসিম শাবানা ছাড়িয়ে আনোয়ার হোসেনে পৌঁছানোর আগে আমি হাত উঁচু করে থামালাম,
‘টাকা লাগবেনা। তবে এই অপমানের বদলা আমি নেব।’
আব্বা হাসলেন আবার। বড্ড মিষ্টি হাসি। আমার দেখে গা জ্বালা দিয়ে উঠলো। তিনি বললেন,
‘অবশ্যই নেবে বাবা। বসো, চা টা খাও। গুলশান উত্তরা ছেড়ে গরিবের বাড়ি আসছো। ও পুরবী.. জসীমকে চা টা দাও।’
আব্বা খিক খিক করে হাসলেন। ইচ্ছা করলো এখনই গিয়ে আব্বার লুকানো বেনসনের খনির কথা আম্মুকে বলে দিই। কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম ওতে আমারই ক্ষতি বেশী। রাত বিরাতে সিগারেট খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এই অস্ত্র ব্যবহার করার উপযুক্ত সময় খুঁজছি।
.
আদ্রিতার সাথে দুইদিন দেখা হয়নি। দেখা করবো।
টাকার বড্ড প্রয়োজন।
আম্মু চা করছে। ওদিক ফিরে। আম্মুর চুলের খোঁপা খুলে যাচ্ছে বারবার। আমি রান্নাঘরের দরজার একপাশে কাঁধ ঠেকিয়ে চুপটি করে তাকিয়ে রইলাম। আম্মু বললেন,
‘দাঁড়িয়ে না থেকে একটু হেল্পও তো করতে পারিস। নে, ফ্লাস্কটা ধর।’
আমি বিস্মিত হলাম না। আম্মুর খোঁপায়ও একটা চোখ আছে। ভীষণ গুণী একজন মানুষ। ফ্লাস্কটা ধরে আমি গলা নিচু করে বললাম,
‘তুমি মাশাল্লাহ রুপে গুণে কম নও। এইরকম একটা লোকের পাল্লায় কেন পড়লে আম্মু?’
আম্মু ফিক করে হাসলেন। আব্বা সম্পর্কে যেকোনো পঁচানো মন্তব্যে আম্মু অধিক মাত্রায় খুশি হন। এখন তিনি প্রচুর হতাশ হওয়ার একটা ভং ধরবেন, তারপর বলবেন,
‘কি করবো, কপালের লিখন, যায়না খন্ডন।’
আম্মু মিষ্টি হেসে বললেন,
‘আমি তো পছন্দই করতাম না। প্রাইভেট পড়াইতে আসতো। একটু ভুল করলেই অমনি কড়া ধমক। হ্যাই মেয়ে, এসব কি, কি এসব, এইভাবে পাস করবা এইচ এস সি? এইটা তো সহজ রেওয়ামিল। বেকুব মেয়ে।’
আম্মুর চোখে স্বর্গীয় আনন্দ। তিনি ওটা চেপে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। আমি বললাম,
‘এখন তো কড়ায় গণ্ডায় উসুল করছো সব।’
আম্মুর চোখে মুখে বিজয়ীর ভঙ্গি ফুটে উঠলো। কথা সত্য। আমি মুগ্ধ চোখে তাকালাম আম্মুর দিকে। টাকার প্রয়োজন হলে আমি কয়েক সেকেন্ড পর পর মুগ্ধ হই। আম্মু বিজয়ীর ভঙ্গি চেপে হতাশ স্বরে বললেন,
‘একশত টাকা আছে মাত্র। এর বেশি একটা পয়সাও দিতে পারবোনা আগে ভাগে বলে দিচ্ছি।’
আমি বিস্মিত হলাম না। আম্মু আমার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখেই কি চাচ্ছি বুঝে ফেলেছেন। ভীষণ গুণী একজন মানুষ। আমি হাত পেতে বললাম,
‘ওতেই চলবে। বাই দ্য ওয়ে আম্মু, তুমি দিন দিন আদ্রিতার চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠছো। আদ্রিতা জানলে ভারী রাগ করবে।’
আম্মু ফিক করে হেসে বললেন,
‘ফাম দিস না। ফাম দিস না।’
আমি এবারও বিস্মিত হলাম না। আম্মু শুধুমাত্র ঘরের অভ্যন্তরে পড়ে নেই, দুনিয়ার সব খবরাখবর রাখেন। গুণী মানুষ বলে কথা।
বাইরে বের হওয়ার সময় দেখি আব্বা ডিসকভারি দেখছেন। আমায় দেখে হাততালি দিয়ে বললেন,
‘জসিম, আসো... বসে দেখো হারামজাদার কাণ্ড। ছোট্ট একটা বরশী পানিতে ফেলে বসে আছে। মাছগুলো এত্ত শেয়ানা। টোপের আশেপাশে গিয়ে মিসকল দিচ্ছে। টোপ গিলছেনা। দেখে অঞ্জন দত্তের গান মনে পড়ে গেলো..’
আব্বা গুনগুন করে অঞ্জন দত্ত গাইলেন,
‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো বলেছে পাড়ার দাদারা, অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই...'
আমি মানিব্যাগ খুলে একটা বিশেষ কায়দায় একশত টাকার নোট’টা পকেটে ঢুকালাম। একটু সময় নিয়ে। আব্বা গাইতে গাইতে আড়চোখে তাকিয়ে কপালে তিনটা ভাঁজ ফেলে বললেন,
‘বিশটাকা গাড়ি ভাড়া, পনের টাকার নাস্তা করবা। বাকি আশি টাকা ফেরত দিবা।’
আব্বা হিসাবেও কঞ্জুসী করতে ভালোবাসেন। একশত থেকে পঁয়ত্রিশ মাইনাস হলে বিয়োগফল আশি হয়না। আব্বার হিসাবে হয়। আমি পাত্তা দিলাম না। বরং একহাত বাড়িয়ে দিলাম।
আব্বা আমার পাতানো হাত দেখে প্রথমে খিক খিক করে হাসলেন। হাসি দেখে মনে হলো, তাহসান স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। আব্বা অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে শার্টের পকেট টেনে পুরোটা বের করে বললেন,
‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে হেল্প করতে পারছিনা বলে বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। দেখেন খালি...’
আমি মুচকি হাসলাম। আব্বা অতি দ্রুত সিরিয়াস হয়ে গেলেন। আমার এই হাসির সাথে তিনি পরিচিত। তাছাড়া এটাও জানেন, ডান হাত পাতলে বাম হাতে কিছু না কিছু থাকে আমার। অস্ত্র। আব্বা ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,
‘ঘটনা কি?’
আমি মুখটা আব্বার ঘাড়ের কাছে এনে গলা নিচু করে বললাম,
‘আলমিরার ডান সাইডের ড্রয়ার গুলি বড্ড ময়লা হয়ে আছে। আম্মুকে বলবো একটু ঝেড়ে দিতে। কি বলো তুমি?’
আব্বা বিরসমুখে হ্যাঙারে ঝুলানো শার্টের পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে অসহায়ের ভং ধরলেন,
‘মাসের শেষদিক আব্বা.. বুঝতে চেষ্টা করো..’
আমি মাথা নাড়লাম।
ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি রান্নাঘরের দিকে মুখ করতেই আরেকটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের হলো। আব্বা মুখ ভার করে বললেন,
'একটা কাজ করতে হবে। একটা প্যাকেট দেব, ওটা অফিসের দারোয়ানকে দিয়ে আসবা বাসায় আসার পথে। কেমন?'
আব্বার বিজনেস সেন্স দুর্দান্ত। আগাগোড়া ব্যবসায়ী। দেখতে পাচ্ছেন, একশত টাকা জলে যাচ্ছে- তাও কিছুটা উসুল করে নিচ্ছেন।
আমি মাথা নাড়লাম। কাজটা করে দেয়া যাবে। দুইটা চকচকে পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে এলো তারপর। আমার চোখ চকচক করলো কিছুক্ষণ।
আব্বা চোখে অন্ধকার দেখলেন। ডিসকভারি চলছে তখনো। বরশীতে ইয়া বড় একটা মাছ টোপ গিলেছে। আমি গুনগুন করে গাইলাম,
‘ধরা দিল কেউ অল্প চাওয়াতে, উড়ে গেল কিছু গল্প হাওয়াতে...’
.
‘হ্যালো, আদ্রিতা...’
‘জি ভাইয়া, বলুন’
আমি হকচকিয়ে গিয়ে নাম্বার চেক করলাম। না, আদ্রিতারই নাম্বার। আদ্রিতার কঠিন কন্ঠস্বর। আমি আদুরে স্বরে বললাম,
‘কি হয়েছে আদু?’
‘দুই দিন পর আসছো জানতে কি হয়েছে তাইনা? এ্যাই অয়েট অয়েট, আদু কাকে ডাকো, ছিহহ, কি উদ্ভট নাম!'
এই না হলে নারী। ভাইয়া ডাক স্বাভাবিক, কেননা এটি সে ডেকেছে। আদু অস্বাভাবিক, কারণ আদর করে এটি আমি ডেকেছি। বললাম,
‘আদু তুমি আমাকে ভাইয়া ডাকছো কেন?’
‘আমি রাগ করেছি।’
আদ্রিতা বড্ড কিউট। সাধারণত মেয়েরা রাগ করলে কখনোই বলেনা, আমি রাগ করেছি। প্রেমিককে রীতিমত সাধনা করতে হয় রাগের কারণ জানতে। আমার এক বন্ধু প্রেমের তিন বৎসর পার হওয়ার পর জানতে পেরেছিলো তার প্রেমিকা প্রথমবার রাগ করেছিলো দুই বৎসর তিন মাস দুই দিন আগে- আটাশ তারিখ বুধবার বিকেল তিনটা পঁয়ত্রিশ মিনিট তের সেকেন্ডে তার পাঠানো মেসেজের রিপ্লাই করতে সতের সেকেন্ড লেইট করেছিলো বলে। আমার অত সাধনা করতে হয়না। আমি জানি, আদ্রিতা নিজ থেকেই বলবে।
বসে আছি এখন, বিভা উদ্যান।
আদ্রিতা আমার পাশ ঘেঁষে ওদিক মুখ করে বসে আছে। আদ্রিতার রাগের কারণটা অদ্ভুত। আদ্রিতা নিজেও যথেষ্ট অদ্ভুত। একটু আগেই মুখ ভার করে বললো,
‘আমি খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছি। আমার খুব মন খারাপ।’
আমি ঢোক গিললাম। আমার স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। ঠেলাগাড়ির চেয়েও ভয়ানক কি হতে পারে। আদ্রিতার স্বপ্ন আরো ভয়ংকর!
‘স্বপ্নে দেখলাম তুমি একটা চকচকে লাল প্রাইভেট কার নিয়ে আমাদের রাজপ্রাসাদের মতোন বিশাল বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েছ। নিচতলায় গাড়ি পার্ক করে ওখান থেকে মাঝারি সাইজের এরোপ্লেনে করে দোতলায় এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলছো, গুড মর্নিং।’
আমি পর পর দুইবার ঢোক গিলে বোকা মেয়েটিকে বললাম,
‘এটা বাজে স্বপ্ন কি করে হয় রে আদ্রি? এ তো বিরাট স্বপ্ন।’
আদ্রিতা আমার দিকে মুখ করে নরম স্বরে বললো,
‘টাকা পয়সা হইলে ভালোবাসা কমে যায় গো। আমি তো চাই তুমি করিম চাচার মতোন একটা ঝুপড়ি ঘরে থাকো। আর ঠেলাগাড়ি চালাও।’
আমার হেঁচকি উঠলো। আদ্রিতা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বললো,
‘তুমি ঠেলাগাড়ি চালাবা আর আমি মাঝে মাঝে ঠেলাগাড়ি করে ঘুরতে বের হবো। দারুণ হবে। তিন চারটা টিফিন বক্স নিয়ে বের হবো। পথে খাবো। ঠেলাগাড়ির উপর শুবো। আমাদের ছোট্ট টাইটানিক সংসার। তুমি চালাবা, বাস ট্রাক শোঁ করে পাশ কেটে যাবে, আমি দুষ্টুমি করে বলবো, ওস্তাদ.. ডাইনে চাপেন, বাঁয়ে পেলাস্টিক। হি হি!’
আমি ঢকঢক করে পানি খাই। আড়চোখে তাকাই আদ্রিতার দিকে। ওর তুলতুলে গালে একটুকরো রোদ, টলটলে সোনালী আভা। ওর গায়ে নিষ্পাপ ঘ্রাণ। পৃথিবীর কুৎসিত রুপ এখনো না দেখতে পাওয়া একটা চমৎকার ঘাসফুল। একান্তই আমার আঙিনায় ফুটেছে যে ফুলটি। আমি সারাজীবন আগলে রাখবো।
.
আদ্রিতার ফোন এসেছে।
আদ্রিতা ফোন কানে নিয়ে আমার থেকে একটু দূরে সরে বসতেই আমি বুঝে গেলাম কে ফোন করেছে। আব্বা। আদ্রিতা নিজের আব্বার সাথেও কথা বলার সময় আমার থেকে দূরে সরে বসেনা। আমি শংকিত হলাম। একশত টাকার শোকে এই লোক পুনরায় একটা প্যাঁচ লাগাবে। আমি আম্মুকে ফোন দিলাম, আম্মুর খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেলাম,
‘তোকে নাকি আদ্রিতা ভাইয়া ডাকতেছে, হি হি...’
আমি হতাশ হয়ে আদ্রিতার দিকে তাকাই। এবং সিউর হই, আমাদের বাচ্চা তিন চার মাসেই দুনিয়ার মুখ দেখবে। এই মেয়ের পেটে কোনো কিছুই বেশিদিন জমে থাকেনা।
আব্বা এই 'ভাইয়া' সংবাদ অতি দ্রুত সবাইকে দিয়ে ফেলবেন। অলরেডি আম্মুকে দিয়ে ফেলেছেন। আম্মু হাসি চেপে বললেন,
'মন খারাপ করিসনা, বিয়ের আগে তোর আব্বারেও আমি ভাইয়া ডাকতাম..'
আমি আড়চোখে আদ্রিতার দিকে তাকাই।
আদ্রিতা কথা বলতে বলতে আড়চোখে এদিকে তাকাচ্ছে। চোখভর্তি লকলকে আগুন। আমি অসহায় স্বরে ডাক দিই,
‘আদ্রিতায়ায়ায়া...’
বিভা উদ্যানে এক চিকন সন্ধে নামছে। আদ্রিতা ফোন রেখে আমার পাশ ঘেঁষে চুপচাপ বসে আছে। ঝড়ের পূর্ব নির্জনতা, থমথমে ভাব। আমি ঢোক গিলে বললাম,
'আব্বা কি বলছে? এই লোকটা প্রচুর মিথ্যে বলে জানো?'
আদ্রিতা থমথমে স্বরে বললো,
'তোমার ব্যাগটা দেখি..'
আমি ব্যাগ বাড়িয়ে দিলাম। কি আছে ব্যাগের ভেতর। দেখো.. দেখো। চেইন খুলে উপুড় করে দিলাম একদম। আদ্রিতা কালো প্লাস্টিকে মোড়া প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বললো,
'এটা কি?'
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
'ওহ গড! ওহ গড! বিশ্বাস করো আমি জানিনা, আব্বা দিয়েছে এটা, অফিসের দারোয়ানকে...'
কথা শেষ হওয়ার আগে আদ্রিতা প্যাকেট ছিঁড়ে ফেললো টেনে। আমি আঁতকে উঠলাম। আরডিএক্স না তো! ভেতরে ভয়ংকর কিছু থাকলে আমায়ও এইভাবে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে সে। ভেতরে কি আছে দেখার জন্য আদ্রিতার সাথে আমি নিজেও যথেষ্ট পরিমাণ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছি। সর্বনাশ! বেনসনের প্যাকেট। আদ্রিতার লালচে চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এরচেয়ে আরডিএক্স হলেই ভালো হতো।
আব্বাকে আমার এই মুহূর্তে ডার্ক নাইটের জোকার বলে মনে হচ্ছে। কি দুর্দান্ত ক্রাইম!
আদ্রিতা প্যাকেট কোলে নিয়ে বসে নরম স্বরে বললো,
'চুরি করে খাবা কেন, আমার সামনে খাও।'
একমাত্র নারীই পারে পুরুষকে এমন জটিল অনুরোধ করতে। যে অনুরোধের কোনো দিকই নিরাপদ নয়। এখন আমি চুপ করে বসে থাকলেও কেয়ামত হবে, হাত বাড়িয়ে প্যাকেট হাতে নিলেও হবে।
আদ্রিতা দুই হাতে টেনে প্যাকেট কুচিকুচি করলো ধীরে সুস্থে, প্রচুর ধৈর্য ওর। একটা একটা সিগারেট টুকরো টুকরো করে বললো,
'যাও, বাসায় যাও। আর দশদিন চোখের সামনে পড়বানা আমার।'
সন্ধ্যে পুরোপুরি নেমে গিয়েছে বিভা উদ্যানে।
আমি ব্যাগ হাতে একা বসে আছি। মন অত্যাধিক পরিমাণে খারাপ। ফেসবুকে ঢুকেছি।
আব্বা ফেসবুকে স্টাটাস দিয়েছেন, মান্না দে'র বিখ্যাত গানের লাইন,
‘সে আমার ছোটবোন, অতি আদরের ছোট বোন!'
আমায় উদ্দেশ্য করেই লেখা। রাগে আমার কপালের শিরা ফুলে উঠলো। সিদ্ধান্ত নিলাম আজকেই বাসায় ফিরে বেনসনের খনির তথ্য চালান করবো সিক্রেট এজেন্সির কাছে। আম্মুর ধুম ধড়াম হাঁড়ি পাতিল আছাড়ের শব্দ, টেবিলে দুইটা বেনসনের প্যাকেট, সোফায় আব্বা হেলমেট পরে বিরস মুখে বসে আছেন- কল্পনা করতেই গায়ে শিহরণ দিয়ে উঠলো। আমি খিক খিক করে হাসলাম, আর একটু অপেক্ষা করো.. আইজ পাশা খ্যালবো রে শাম...।
.
বাসায় ফিরেছি।
আম্মু দুই হাত পেছনে নিয়ে আদুরে স্বরে বললেন,
‘আসছো? বসো বাবা। এ্যাই কবির, সোফাটা টেনে এদিকে নিয়ে আসো তো, সাহেব হেঁটে গিয়ে বসবেন.. কষ্ট হবে উনার!’
আম্মুর অতিরিক্ত আদর এবং পেছনে আব্বার আলাভোলা মুখ দেখেই আমি সতর্ক হয়ে দাঁড়ালাম। কোথাও কোনো গন্ডগোল আছে। আব্বা উদাস স্বরে আম্মুকে বললেন,
‘থাক পুরবী, ছেলেমানুষ... ভুল চুল করতেই পারে।’
‘না, তুমি আমায় থামাবানা।’
আব্বা কাতর হওয়ার ভং ধরলেন। কি পরিমাণ ভংবাজ লোক! আমি ঢোক গিলে বললাম,
‘কি সমস্যা আম্মু?’
আম্মু ঝাড়ু হাতে তেড়ে এলেন। আমি ধপ করে সোফায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আম্মু টেবিলের উপর দুইটা বেনসনের প্যাকেট ছুঁড়ে চিৎকার করলেন,
‘তোর সাহস কত, আমার রুমেই সিগারেট লুকাস। চুরি করে রাতদুপুরে বাসার ভেতরেই সিগারেট খাস... ভাগ্যিস তোর আব্বা চশমা খুঁজতে গিয়ে পাইলো, নইলে তো আমি জানতাম ই না। হারামজাদা তোরে আজ উল্টা করে বেঁধে সিলিং-এ ঝুলিয়ে চায়ের সাথে সিগারেট গুলায়ে খাওয়াবো দাঁড়া...’
শরীর উল্টা করে ঝুলিয়ে তরল কিছু জোর করে খাওয়ানো অসম্ভব। আম্মুর জন্য সম্ভব। জটিল গুণী মানুষ তিনি।
রাত আট টা ত্রিশ।
আব্বা চা খেতে খেতে ছবি দেখছেন। ছবিতে নায়িকা এসে শাকিল খানকে বলছে, কেন তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবেনা? নায়ক শাকিল খানের হাতে ব্যান্ডেজ, সে দরদী গলায় বলছে, আমার মনটা যে অন্য কারোর কাছে পড়ে আছে। এ্যাই পাগলী, তুই কি আমায় ভাই হিসেবে ভালোবাসতে পারিস না, বল পারিস না? বল বল...
নায়িকা এসে ‘ভ্যাইয়ায়ায়ারে... তোর জন্য আমি সব করতে পারি, আমার ভ্যাইয়া’ বলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আব্বা খিক খিক করে হাসছেন। আম্মু রান্নাঘরে ধড়াম করে হাড়ি পাতিল আছাড় দিয়ে জানাচ্ছেন, রাগ একটুও কমেনি এখনো। টেবিলে বেনসনের দুটো প্যাকেট। আমি সোফায় আব্বার হেলমেট পরে বসে আছি..!!!
সমাপ্ত

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)