রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ২৩)


সকালের নাস্তার জন্য মিনু শেখ নিশুতিকে ডেকে নিলেও পুরো নাস্তাটা একা নিশুতিরই করা লাগে। একা হাতে। নাস্তা বানিয়ে রুমে ফিরে দেখে প্রায়াণ আবার ঘুমিয়ে গেছে। নিশুতির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস পিছলে পড়ে অজান্তেই। সে চুপচাপ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে প্রায়াণ জেগে গেছে। একটা কেমন জানি চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কপালের ভ্রু দুটি কিঞ্চিৎ কুঁচকে নিশুতি জিজ্ঞাসা করে, "কি?"
প্রায়াণ দায়সারাভাবে বললো, "তুমি এটা কেমনে পারলা করতে??"
নিশুতি অবাক হয়। গলায় বিষ্ময় ঢেলে বলে,
"কি করলাম??"
"আমাকে না উঠিয়ে একা ওয়াশরুমে গিয়ে কেমনে ফ্রেশ হইলা তুমি??"
"তো কি হইছে তাতে?"
"আমার কত শখ ছিল বাসর রাতের পরের সকাল টা আমার বউয়ের সাথে একসাথে ফ্রেশ হবো আমি। আর তুমি...!"
হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিশুতি বলে,
"বাসর রাতই হলো না। আবার তার পরেরদিন!" নিশুতির গলায় অভিযোগের ছোঁয়া পায় প্রায়াণ। সে বিছানা থেকে উঠে নিশুতির সামনে এসে দাঁড়ায়। নিশুতির চিবুকে হাত রেখে বলে,
"অভিযোগ খুব?"
নিশুতি মাথা দুলায়। অর্থাৎ 'না'। কিন্তু তার চোখ বলছে হ্যাঁ ভীষণ অভিযোগ আমার। ভীষউউউউউণ...
প্রায়াণ কিছু বলতে নেওয়ার আগেই নিশুতি বলে উঠে,
"জানো আমার বাসর রাত টা আজীবন মনে থাকবে আমার! সো স্পেশাল। তাই নয় কী?"
প্রায়াণ উত্তর দেয় না। নিশুতির চোখে স্পষ্ট জল কণা চিকচিক করছে। নিশুতি বহু কষ্টে আটকে রেখেছে তা। প্রায়াণের থেকে সরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একটা বেগুনি রংয়ের জামদানির শাড়ি পড়েছে সে। প্রায়াণই এসব কিনে এনেছিল কাল তার জন্য..আগাগোড়া নিজেকে একবার দেখে নেয় পরিপাটি ভাবে। বিবাহিত জীবনের আজ দ্বিতীয় দিন তার! অথচ...মনের কোথাও একটা সুখ নেই। সব থেকেও কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে সব তার কাছে। এরকম টাই বুঝি হওয়ার ছিল! বোধহয়... মনে হয়।
নিশুতিকে আনমনা দেখে প্রায়াণ এগিয়ে আসে তার দিকে একপা দুপা করে....
বেশ হালকা ভাবেই জড়িয়েই ধরে পেছন থেকে প্রথমে...তারপর দুহাতের বন্ধন শক্ত করে নেয় ধীরে ধীরে।
"মন খারাপ?"
"উঁহু।" নিশুতির ছোট্ট জবাব।
"মিথ্যে বলছো। কিছু তো হয়েছে সিউর। বলো আমাকে!"
"বললাম তো কিছুই না।"
নিশুতিকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরায় প্রায়াণ। নিশুতির চোখে চোখ রাখে। অস্থির কণ্ঠে বলে,
"এবার বলো।"
নিশুতি থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। একরাশ বিষন্নতা গ্রাস করছে তাকে। কেমম যেন করে...! নিশুতি ছলছল চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। কিছু বলতে নেওয়ার আগেই দরজায় নক পড়ে।
প্রেমার গলা,
"ভাইয়া...ভাইয়া আম্মু ডাকে খেতে তোমাদের।"
নিশুতি প্রায়াণের বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সে যেন এই কড়াঘাতেরই অপেক্ষায় ছিল। চোখের পানি টুকু চোখ দিয়েই ভেতরে শুষে নিয়ে বললো,
"ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো।"
.
.
খাওয়া দাওয়ার পাট টা বেশ ঠিকঠাক,কোনো ঘটনাবিহীন ভাবেই চুকে যায়। বেলা ১১ টার দিকে বেশ কিছু মহিলা আসে। প্রায়াণের বউ দেখতে। সম্পর্কে এরা নিশুতির শ্বাশুড়ির ফ্রেন্ড, প্রতিবেশী। নিশুতি লক্ষী বউয়ের মতো সবাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। নিশুতির হাসিমুখ দেখে সবাই-ই খুশি হয় বেশ। দোয়া করে,সে যেন তার স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই থাকে সবসময়। দোয়া শুনে নিশুতি দায়সারাভাবে হাসে শুধু। সে হাসি না জীবন্ত,না প্রানবন্ত। এইসব দোয়া গুলোও তার কাছে মিথ্যে আশ্বাস, জোকস আর সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
.
.
নম্রতাকে নিয়ে নিজের রুমে আসে মিনু শেখ। ভালোকরে দরজা টা আটকে দেয় সে। নম্রতা চকিতে বললো,
"কিছু বলবেন আন্টি?"
"আগে খাটে তো বসো। বলার জন্যেই তো ডেকেছি।"
নম্রতা বিছানায় বসে। পাশে মিনু শেখ। ফিসফিস করে বলে,
"আমি প্রায়াণের থেকে নিশুতিকে দূরে দূরেই রাখছি। চিন্তা করো না। বিয়ে করলেই একে অপরের হয়ে গেলো না। নিশুতি আর প্রায়াণের যেন মিলন কোনোদিনও না ঘটে সে দায়ভার আমার। তুমি কোনো চিন্তাই করো না তো। তোমার প্রায়াণ তোমারই থাকবে।"
কথাটা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নম্রতা। পরমুহূর্তেই তার অস্থির ভাব কেটে যায়। না চাইতেও একটা সুখের শ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিড়ে।
.
.
কয়েকদিন কেটে যায় এভাবেই। প্রায়াণ আর নিশুতি যতবারই একে অপরের কাছে আসতে গিয়েছে কোনো না কোনো বাহানায় তাদের আলাদা করে দিয়েছে মিনু শেখ। প্রায়াণ সব কিছুই বুঝতে পারে। কিন্তু কিছু বলার মুখ নেই তার। মায়ের বিরুদ্ধে কথা কিভাবে বলবে!
.
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আছে প্রায়াণ। অয়ন আসে দু কাপ চা নিয়ে।
"দোস্ত নে।"
প্রায়াণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ তার থেকে চায়ের কাপ টা নেয়। অয়ন প্রায়াণের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে,
"দোস্ত কোনো প্রবলেম? উদাস দেখাচ্ছে!"
প্রায়াণ নির্লিপ্ত ভাবে বলে,
"না রে কিছু না।"
অয়ন তার হাত খানা প্রায়াণের কাধে রাখে।
"বলতে পারিস আমাকে ভাই। কি হইছে?"
"বিয়ের আজ ১২ দিন হলো। এই পর্যন্ত একটা বারোও নিজের স্ত্রী কে নিজের করে পেলাম না ভাই। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও বলি, প্রতিটা মানুষেরই একটা জৈবিক চাহিদা থাকে। বিয়ের পর সেই চাহিদা আরো বেড়ে যায় হুট করেই। আর স্ত্রীর সাথে একান্তে কিছু মুহুর্ত কাটাতে চাওয়া কিন্তু পাপ না। আমিও সেই চাওয়া টাই চাইছি। বাট কিছুতেই পাচ্ছি না রে ভাই!" প্রায়াণের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পিছলে পড়ে।
অয়ন অবাক হয়ে কথাগুলো শুনে। চমকিত হয়ে বললো,
"কেন? তোর বউ-ই কি তোর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে??"
"নাহ।"
"তবে??"
প্রায়াণ এই উত্তরের আর জবাব দেয়না। ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাসায় ফিরতে হবে তার।
.
.
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় প্রায়াণের। খেয়েদেয়ে রুমে এসে দেখে নিশুতি বিছানা গোছাচ্ছে। প্রায়াণ কে আসতে দেখে অভিমান মাখা কণ্ঠে বলে,
"না আসলেও পারতে!.ইদানীং বাহিরেই সময় কাটাও বেশি!"
প্রায়াণ উত্তর দেয় না। চুপচাপ নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে। নিশুতি কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে রয়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
.
.
রাত ১১ টা।
পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনেই। অথচ কারো মুখে কোনো বুলি নেই। নিশুতির হুট করেই ভীষণ কান্না পায়। মনে পড়তে থাকে সিলেট ভ্রমণের সেই দিনগুলির কথা। তখন তো জীবন টা কত রঙিন ছিল অথচ এখন! একদম পানসে লাগছে সব কিছু।
নিশুতি আড়চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ সোজা হয়ে সিলিং এর দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। মুখটা থমথমে,গম্ভীর...
নিশুতি হালকা অথচ দুর্বল গলায় বললো,
"কিছু হয়েছে তোমার?"
প্রায়াণ এবারো নিশ্চুপ। জবাব নেই কোনো। নিশুতি উঠে বসে। প্রায়াণের কাছে এগিয়ে এসে তার ডান হাত টা প্রায়াণের কপালের উপর রাখতেই প্রায়াণ খেকিয়ে উঠে।
"ছোঁবে না তো। বিরক্ত লাগে!!"
নিশুতির চোখে বিষ্ময়, হতাশা...সে বিমূঢ় হয়ে বসে রয়। প্রায়াণ অন্যপাশ ফিরে শোয়। বলে,
"এখনো এখানে কি? যাও না। প্রতিদিন তো শ্বাশুড়ির সেবা করে কাটাও। আজকেও যাও। এখানে থাকার তো কোনো মানে দেখছি না!"
নিশুতির বুক ভেঙে কান্না পায়। সে ফাকা ঢোক গিলে কতগুলো। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
"তোমার মা আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। এতে আমার দোষ?"
প্রায়াণ কঠিন গলায় বলে,
"জানিনা। জাস্ট যাও এখান থেকে। তোমার উপস্থিতি আমার ভালো লাগছে না।"
নিশুতি কষ্ট পায়। গভীর কষ্ট। সে ধীরে ধীরে সরে আসে প্রায়াণের থেকে। তারপর এক ছুটে বেড়িয়ে যায় রুম যায়। যাওয়ার সময় দরজার পাশে দাঁড়ানো মিনু শেখ কেও নজরে পড়ে না তার...
.
.
প্রেমা পড়ছিল রাত জেগে।
হঠাৎ দরজায় নক পড়তে বিরক্তবোধ করে সে। কিন্তু অবাক হয় যখন দেখে নিশুতি দাঁড়িয়ে।
"তুই?"
নিশুতি অশ্রুসিক্ত চোখে বললো,
"তোর সাথে আজ রাত টা থাকতে দিবি??"
চলবে...
অয়ন প্রায়াণের ভার্সিটি ফ্রেন্ড। গল্পটা বাংলা মুভি,বা হিন্দি সিরিয়ালের মতো হয়ে যাচ্ছে না? অথচ চোখ মেলে দেখুন। এরকম হাজার হাজার ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের আশেপাশে। কিন্তু আফসোস,সেখানে প্রেমা রাও থাকে না। চোখের পানিতেই নির্ঘুম রাত কাটে ভালোবেসে বিয়ে করা অনেক বউয়ের
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)