রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১৪)


নিশুতির গাল দুটো ফুলা ফুলা। নাক কিঞ্চিৎ লাল। প্রায়াণ ভয়ার্ত গলায় বলে,
--------কি হইছে জা....
নিশুতি ক্ষেপে উঠে।
--------এক ঘন্টা হয়ে গেছে বাহিরে বের হইছো যে। আর আসতে মনে থাকে না?? আসবা ক্যান!! কেউ তো আর অপেক্ষায় নেই তোমার। বাহিরে এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে,ওদের রেখে কী আর এই ডালভাতের কাছে আসতে ইচ্ছে হয়??
নিশুতির কণ্ঠে কঠিন তেজ। প্রায়াণ চমকায়। নিশুতি রাগ তার জন্য না,নিশুতির তাকে এই প্রথম তুমি করে বলেছে,সেই জন্য। আহা কি মিষ্টি ওর তুমি বলা!
প্রায়াণ আমতাআমতা করে বলে,
--------আরেকটু বকা দিবা? ইয়ে মানে ভালোই লাগছে শুনতে।
নিশুতি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় প্রায়াণের দিকে। প্রায়াণের হার্টবিট মিস হয় পরাপর। আবারো আমতাআমতা করে বলে,
--------এভাবে তাকিয়ো না,হার্ট ফেইল হবে।
প্রায়াণের বোকা বোকা কথায় নিশুতির রাগ কমে যাচ্ছে। একদম...শূন্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছে। অদ্ভুত!
নিশুতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠে। প্রায়াণের চোখ এড়ায় না তা। মনে মনে সে নিজেকে নিয়ে গর্ব করে। বুক ফুলানো গর্ব। বিনা ঝামেলায় নিশুতির রাগ যে গলাতে পারলো সে!
নিশুতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েই বলে,
------কোথায় ছিলেন?
আহঃ! আবারো সেই আপনি! ধ্যাৎ!!
প্রায়াণ বিরক্তি লুকিয়ে বললো,
--------নিচে।
--------সে তো আমিও জানি। কিন্তু নিচের কোথায়?
প্রায়াণ নিশুতির সামনে এসে বলে,
--------আগে চোখ বন্ধ করো। নিজেই বুঝতে পারবা।
নিশুতি প্রথমে একটু অবাক হলেও কথা বাড়ায় না। নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। প্রায়াণ দ্রুত পায়ে গিয়ে রুমের দরজা খুলে। বাহিরেই পার্সেল টা রাখা। সেটা নিয়ে আবার রুমে এসে দরজা আটকে দেয়। নিশুতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নিজের চোখ দুখানা খোলার জন্য৷ অবশেষে চোখ মেলার অনুমতি পায় সে। মিটমিট করে চোখ খুলতেই দেখে প্রায়াণ হাসি হাসি মুখে একটা পার্সেল তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বেশ বড়সড় সেটা। নিশুতি অবাক হয়েই হাতে নেয় সেটা। ওমা!! বেশ ভারী..!!
নিশুতির হাত ভেঙে পার্সেল টা নিচে পড়ে যেতে নিলেই প্রায়াণ ধরে তা। মুখে তার দায়সারা হাসি যেন নিশুতিকে বোঝাচ্ছে এতো বড় হলে,অথচ শক্তি হলো না!
দুজনে মিলে পার্সেল টা নিয়ে বিছানার উপর বসে। নিশুতি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
-------কি আছে এতে?
প্রায়াণ এসির তাপমাত্রা টা আরেকটু কমিয়ে দিতে দিতে বলে,
--------নিজেই দেখো।
নিশুতি বেশ তাড়াহুড়ো করে পার্সেল টা খুলে। নিশ্চয়ই কোনো সারপ্রাইজ। আর সারপ্রাইজ পেতে তার ভীষণ ভালো লাগে। ভীষণ....
তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে রেপিং পেপারের বেশ কিছু জায়গা ছিড়ে ফুড়ে একাকার। প্রায়াণ অদ্ভুত চাহনিতে তাকায় নিশুতির দিকে। সে চোখ যেন বলছে, একটুও ধৈর্য নেই মেয়েটার! নিশুতি বোকাভাবে হাসে শুধু।
পুরো রেপার খুলে বক্স টা খুলতেই নিশুতির পিলে চমকে যায়। এক গাদা বইয়ে ঠাসা বাক্স টা।
নিশুতি উল্লাসিত চোখে একবার তাকায় প্রায়াণের দিকে,আরেকবার বাক্সের দিকে। প্রায়াণ জানতো নিশুতি খুশি হবে,অনেক খুশি হবে...
নিশুতির বাক্স উল্টে সব বই বিছানার উপর ফেলে। একটা একটা করে বইয়ের নাম দেখে৷ ১০ টা বই। ৭ টা হুমায়ুন আহমেদ এর আর বাকি তিনটা অন্যান্য নামকরা লেখকদের নোবেল বিজয়ী উপন্যাস।
নিশুতির দুচোখ বেয়ে পানি উপচে পড়ে। প্রায়াণ অবাক হয়।
হতচকিত গলায় বলে,
--------কি হলো? কাঁদছো কেনো আবার?
নিশুতি কান্না কান্না চোখেই প্রায়াণের দিকে তাকায়। বলে,
-------খুশিতে। বেশি খুশি লাগলে আমার কান্না পায় খুব।
প্রায়াণ হেসে ফেলে। নিশুতির কাছে এসে নিশুতির মাথাটা বুকে চেঁপে ধরে। বলে,
--------এ কেমন পাগলি কে ভালোবাসি আমি! যে দুঃখ পেলেও কাঁদে,সুখ পেলেও কাঁদে!
নিশুতি কথা বলে না। তার কান্না টান্না সব শেষ। এক আলাদা প্রশান্তি তার সারা শরীর জরিয়ে ধরছে ধীরে ধীরে...প্রায়াণের বুকে যতবার সে মাথা রাখে প্রতিবারই একটা আলাদা,অদ্ভুত প্রশান্তি তার শরীরে মনে আসে।
কিছুক্ষণ কেটে যায়।
নিশুতি মুখ তুলে প্রায়াণের দিকে তাকায়। রিনরিনে গলায় বলে,
-------কি করে জানলেন আমি বই পড়তে ভালোবাসি?
-------সব সময় একা একা থাকলে ম্যাগাজিন নিয়েই ঘাটাঘাটি করো! তাই আন্দাজে বুঝলাম!
--------থ্যাংকিউ।
প্রায়াণ নিশুতির গাল টেনে বলে,
--------থ্যাংকিউ দিলে কাজ হবে না ম্যাডাম। অন্য কিছু চাই। দিবেন?
নিশুতি প্রায়াণ কে ছেড়ে সটান হয়ে দাঁড়ায়।
-------আগে বলেন। পারলে তো অবশ্যই দিবো।
প্রায়াণ বিছানার উপর বসে বলে,
--------আমাকে তুমি করে বলতে হবে। ব্যস এটুকুই।
নিশুতি ঠোঁট উল্টায়।
বলে,
--------না না না। আমি পারবো না।
---------একটু আগে যে বললে!
---------সেটা তো রাগের বশে..
--------আমি কিচ্ছু জানিনা। আমাকে তুমি করেই বলতে হবে।
--------না বললে??
প্রায়াণ উঠে দাঁড়ায়। দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলে,
--------না বললে এই যে এখন,এই মুহুর্তে, আমি তোমার সামনে উলঙ্গ হয়ে যাবো।
বলেই প্রায়াণ শার্টের বোতাম খোলা শুরু করে তার। নিশুতি দু হাতে মুখ ঢেকে বলে,
--------না না নায়ায়ায়ায়া। প্লিজ না। লজ্জায় মরে যাবো। আল্লাহ!!
--------তাহলে বলো। তুমি আমাকে তুমি করে বলবা।
নিশুতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
--------নো...
প্রায়াণ শার্টের বোতাম খোলা জারি রেখে বলে,
--------ওকে ফাইন। আমিও আজকে উলঙ্গ রাজা হবো তোমার। হে দেবরাণী...
নিশুতি গর্জন করে বলে উঠে,
--------বন্ধ করেন তো এসব ড্রামা। আচ্ছা ফাইন,আমি চেষ্টা করবো বলার।
প্রায়াণ থামে। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে,
--------পাক্কা?
--------হুম।
প্রায়াণ পেছন থেকেই নিশুতিকে জরিয়ে ধরে। নিশুতি মৃদু হাসে শুধু। প্রায়াণ নিশুতির কাধে নিজের মুখ ঘষে। নিশুতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
-------কত বাজে?
প্রায়াণ ঘড়ি না দেখে বলে,
--------৯ টার বেশি। কেনো?
--------ডিনার করবেন না?
প্রায়াণ নিশুতিকে ছেড়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
--------ক্ষুধা পেয়েছে?
নিশুতি মাথা কাত করে।
প্রায়াণ শার্টের বোতাম গুলো আবার লাগিয়ে বলে,
--------তৈরি হয়ে নাও। আজ আমরা ঘরে না,রিসোর্টের ডায়নিং স্পেসে বসে ডিনার করবো।
.
.
টেবিলের মুখোমুখি বসে আছে প্রায়াণ নিশুতি। নিশুতি নুডলস অর্ডার করেছে আর প্রায়াণ ফ্রাইড রাইস উইথ চিকেন লেগ পিস।
খাবার আসতে একটু সময় লাগবে। তাই দুজনেই অপেক্ষা করছে।
নিশুতি চিকচিক চোখে আশে পাশে দেখছে। তাদের মতোই অনেক কাপল এখানে। সবাই হয়তো ম্যারিড। আচ্ছা তাদের বিয়ে হবে কবে? আচ্ছা প্রায়াণের ফ্যামিলি কি নিশুতিকে মেনে নিবে?
নিশুতির ছোট্ট মনে বিশাল একটা ভয় উঁকি মেরে উঠে। সে প্রায়াণের দিকে নার্ভাস চোখে তাকায়। নিচু স্বরে বলে,
--------শুনো।
প্রায়াণ চমকে তাকায় নিশুতির দিকে। ইশশশশ.........
এই শুনো,ওগো,কিগো টাইপ ডাক গুলা আসলেই বড্ড ভয়ংকর। একটা পুরুষের পুরো মনকে হেলিয়ে তুলতে পারে।
প্রায়াণ স্বাভাবিক হয়ে বলে,
-------হুম বলো।
-------আপনার মা কি আমাকে মানবে? আর আপনার বাবা?
প্রায়াণ থমকে যায়। হঠাৎ এইধরনের প্রশ্ন!
--------হঠাৎ এই টাইপের প্রশ্ন করলে কেনো?
--------আহহা! বলুন না।
প্রায়াণ একটু ভেবে নিয়ে বলে,
--------আব্বুকে বোঝালে রাজী হবে কিন্তু আম্মু...দেখা যাক কি হয়! ডোন্ট ও'রি। আমি আছি তো। আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।
প্রায়াণের কথায় নিশুতি আশ্বস্ত হয় বলে মনে হয়না। তার মনের ভয় একটুও কমে না। সে ছোট করে বলে,
-------হু।
প্রায়াণ সেই "হু" র অর্থ বোঝে। নিশুতির হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে,
---------আমার উপর বিশ্বাস আছে তো?
নিশুতি প্রায়াণের চোখের দিকে তাকায়। এই ছেলেটাকে সে বিশ্বাস করে,ভীষণ করে.....
নিশুতি মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়ায়।
প্রায়াণের ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠে।সে বলে,
---------তাহলে বিশ্বাস রেখো। আমি আম্মুকে ম্যানেজ করে নিবো।
---------হুম আচ্ছা।
খাবার চলে আসে। দুজনেই ঝাপিয়ে পড়ে খাবারের উপর। নিশুতি গপগপ করে গিলে যাচ্ছে শুধু। হঠাৎ প্রায়াণের চোখে চোখ পড়ে। প্রায়াণ মুচকি মুচকি হাসছে তার খাওয়া দেখে। নিশুতি থম মেরে যেতেই প্রায়াণ ঠোঁট কামড়ে হাসে। তারপর টিপ্পনী কাটে। নিশুতি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। টেবিলের তলা দিয়ে প্রায়াণের পায়ের উপর গুতো মারতে থাকে। একটা দুইটা না, অনেক গুলা...প্রায়ান ব্যথায় 'উহু' করে উঠে। নিশুতি খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে বলে,
--------আর বলো না,খুব মশা এখানে। খালি টেবিলের নিচ দিয়ে কামড়ায়।
প্রায়াণ থতমত খায়। এই মেয়েটাও না!! পাজির হাড্ডি!
.
.
খাওয়া শেষে দুজনে রুমে ফিরে। প্রায়াণ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে নিশুতি ঘুম। গভীর ঘুম... তার পাশে এখন বোম ফাটলেও টের পাবে কিনা আল্লাহই ভালো জানেন।
প্রায়াণ ভেবে পায়না,নিশুতি এতো ঘুম পায় কই! প্রায়াণ নিশুতির পাশ ঘেঁষে শুতে শুতে বিরবির করে,
---------আমার ঘুম রাণী!
.
মধ্যরাতে একটা চাপা আওয়াজের সুরে প্রায়াণের ঘুম ভেঙে যায়। হাত হাতড়ে দেখে পাশে নিশুতি নেই। প্রায়াণ লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে। বারান্দা থেকে নিশুতির গলার ক্ষীন স্বর ভেসে আসছে। প্রায়াণ ধীর পায়ে উঠে গিয়ে বারান্দার দরজার পাশে দাঁড়ায়। নিশুতি বলছ,
--------কেনো এভাবে একা ফেলে গেলে আমাকে! কেনো গেলে? গেলে তো গেলে আবার স্বপ্নেও আসো। এসে আমাকে কাঁদাও!! কেনো হু কেনো???
প্রায়াণের কলিজা টা ধক করে উঠে। কার কথা বলছে নিশুতি?? তাহলে কি নিশুতির কোনো অতীত আছে...?
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)