রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১৯)


কাল থেকে পিউ'র ফাইনাল পরীক্ষা। তাই নম্রতা সকাল সকাল এসেছে ওকে পড়ার ব্যাপারে খুটিনাটি দেখিয়ে দিতে। এরপর আবার ভার্সিটিও যাবে সে। কথার ছলেই পিউ'র থেকে নিশুতি নামক মেয়ের সব ডিটেইলস জেনে নেয় নম্রতা। এটাও জেনে নেয় যে নিশুতি এখন বাড়ি নেই। অনেকদিন যাবত তার কাকার বাসায় বেড়াতে গেছে।
তাদের পাশেই একটু দূরত্ব নিয়ে বসে আছে প্রত্যুষ। কপালে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভাঁজ তার। মেজাজ গরম হচ্ছে প্রচুর। কালকে থেকে প্রায়াণের নাম্বারে ফোন করে যাচ্ছে,কিন্তু ফোন লাগছে না।
একপর্যায়ে বিরক্ত হয়েই প্রত্যুষ বলে উঠলো,
---------আম্মু আপনার ছোট নবাবের তো ফোনই লাগছে না। ফোন বন্ধ তার।
মিনু শেখ পান বানাচ্ছিলেন। বানাতে বানাতেই বললেন,
---------নম্রতা তোমার সাথে প্রায়াণের কথা হয়েছে মা?
নম্রতা মাথা নাড়ায়। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
---------ওর সাথে আমার গত দুদিনেও কথা হয়নি!!
মিনু শেখ আহাজারি করতে করতে বলেন,
---------প্রত্যুষের অফিসে প্রায়াণের জন্য একটা ভালো পোস্টের কথা বলে রেখেছিল প্রত্যুষ। সেখানে কাল ইন্টারভিউ। অথচ দেখো,ওকে হারিকেন খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। কি ঝামেলায় পড়লাম বলো দেখি মা!
নম্রতা ম্লান মুখে বললো,
---------আমি আর কী বলবো আন্টি!
প্রেমা ধোঁয়া উঠা চা'য়ের কাপ নিয়ে আসে। সে হালকা কণ্ঠে বলে,
---------হয়তো ভাইয়ের ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না।
প্রত্যুষ কিরকির করে উঠে রাগে। বললো,
---------বরিশালের মেইন শহরের সব জায়গায় সব সিমের নেট পাওয়া যায়।
নম্রতা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
----------নিশুতি কে খুঁজি তাকেও পাই না। প্রায়াণ কেও পাই না। কি আজব!
কথাটা বলে নিজেই থতমত খেলো নম্রতা। সে কেনো এই কথা বলতে গেলো কে জানে। কিন্তু তার কথা শুনে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবাই।
নম্রতা মাথা নিচু করে ফেলে। মিনু শেখ বলে উঠেন,
--------তোমার কী কোনো সন্দেহ হচ্ছে নম্রতা?
নম্রতা আমতা আমতা করে বলে,
---------কি জানি! নিজেও জানিনা। এমনিই বললাম আর কি।
প্রত্যুষ কে উদ্দেশ্য করে মিনু শেখ বলেন,
---------জানিস,শেষ যখন প্রায়াণের সাথে আমার কথা হয়,তখন আশেপাশে একটা মেয়ে কণ্ঠ শুনেছি আমি। ঠিকভাবে শুনতে পারিনি তাই বলতেও পারবো না কার কণ্ঠ কিন্তু কণ্ঠ টা আমার অনেক পরিচিত মনে হচ্ছিল।
পিউ মাঝখান দিয়ে বললো,
--------মা ভাইয়া তো তার খেলার কোনো সরঞ্জাম বা জামা কাপড় কিছুই নিয়ে যায়নি।
মিনু শেখ কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রত্যুষ কে বললো,
---------ওর স্পোর্টস টিমের লিডার কে ফোন লাগা। জিজ্ঞেস কর তাকে। নাম্বার আছে না তোর কাছে?
---------হুম আছে আম্মু।
.
.
প্রত্যুষ ফোনে কথা বলার পর মিনু শেখ কে যেটা বললো,সেটা শুনে শুধু মিনুই না,ওখানে থাকা প্রতিটা মানুষই যারপরনাই অবাক হয়।
প্রত্যুষ বললো,
----------ওদের নাকি কোনো খেলা নেই বরিশালে আর ওর লিডার ও ঢাকায়। তাহলে ও কার সাথে গেছে বরিশাল?
কি জন্য গেছে বরিশাল?
পিউ উত্তর দিলো,
-----------ভাইয়া তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছে আর আমাদের জানালো না! হুহ। এবার আসুক ভাইয়া।
মিনু শেখ কঠিন গলায় বলে,
----------ও যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। ওর আর জায়গা হবে না এই বাসায়।
কেউ আর কোনো কথা বাড়ালো না। প্রত্যুষ চুপচাপ নিজের অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো। আর পিউ,স্কুলের জন্য। মিনু শেখ নিজের রুমে চলে গেলেও সোফায় বসে রইলো একা নম্রতা। বুকের ভেতরে নাম না জানা এক তুফান উঠেছে। তাহলে প্রায়াণ কে পাওয়ার যেটুকু আশা ছিল,সেই আশার প্রদীপ ও নিভতে চললো?
প্রেমা চায়ের কাপ গুলো রান্নাঘরে নিয়ে আসে। কাপের ঠান্ডা চা বেসিনের উপর ঢালতে ঢালতে প্রেমা বিরবির করে,
---------প্রায়াণ ভাইয়া তুমি যে কতবড় বাশ খেতে চলেছো,তা তুমি নিজেও টের পাবা না।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
.
.
কোলাহলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নিশুতির। মিটমিট করে চোখ খুলে দেখে প্রায়াণ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। প্রথম যেদিন,এমন হয়েছিল। সেদিন নিশুতির লেগেছিল লজ্জা আর অপ্রস্তুত ভাব। তবে আজ লজ্জা লাগলেও ভালো লাগছে খুব। কেনো যেনো প্রায়াণ কে নিজের মনে হচ্ছে। একদম কাছের কেউ...
নিশুতি নড়েচড়ে উঠে। তাবুর বাহিরে কোলাহলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিশুতি আস্তে করে ধাক্কা দেয় প্রায়াণ কে।
--------এই যে। উঠো না...
প্রায়াণ পিটপিট করে চোখ খুলে তার। একটা হাই তুলে বলে,
---------গুড মর্নিং।
---------গুড মর্নিং। উঠুন না প্লিজ। বাহিরে এতো চিল্লাচিল্লি হচ্ছে কিসের। দেখেন তো।
প্রায়াণ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো,
-----------উহু উঠবো না। দেখবোও না।
-----------কেনো??
-----------এই যে তুমি আমাকে আপনি আপনি করে বলছো তাই!!
নিশুতি ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
----------বাবু আমার। লক্ষী সোনা। দেখো তো বাহিরে কি হচ্ছে। যাও না!
প্রায়াণ হেসে শোয়া থেকে উঠে বসে। নিশুতির কপাল থেকে এলোচুল গুলো আঙুলের ডগা দিয়ে সরিয়ে দেয় আলতো করে। তারপর বলে,
--------তুমি বসো। আমি দেখছি।
প্রায়াণ বেরিয়ে যায়। নিশুতি কম্বলের ভেতরেই বসে থাকে। একটা স্নিগ্ধ ভালোলাগা তার সারা শরীর মন ছেয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে মনে ভাবে,এভাবে যদি প্রতিটা সকাল সে প্রায়াণের স্পর্শে কাটাতে পারতো!
নিশুতির ভালো লাগার অনুভূতি চিরচির করে ফেটে যায় বাহিরের তীব্র কোলাহলে। প্রায়াণেরও গলা পাওয়া যাচ্ছে। অনেক চেঁচাচ্ছে প্রায়াণ। নিশুতি ভয় পায়। সে মাথায় ওড়না দিয়ে বাহিরে বের হয়। আর তখনি দেখে,একদল লোক তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছে অনবরত। তাদের মাঝে ফেসে আছে প্রায়াণ।
প্রায়াণ চিল্লিয়ে বলে,
--------নিশুতি তুমি ভেতরে যাও।
সে কথা নিশুতির কান অব্দি গেলেও সে যায় না। তার পা যেন জমে গেছে ভয়ে। এসব কি হচ্ছে,সেটাই ভাবতে থাকে তার ব্রেইন।
.
.
দুপুরবেলা ছাদ থেকে নামার সময় ইফতির দেখা পায় প্রেমা।
-------ইফতি।
প্রেমার ডাক শুনে ইফতি দাঁড়ায়। আবার কি জিজ্ঞেস করবে প্রেমা,কে জানে!
------জ্বি আপু।
-------নিশুতি কই?
-------এখনো কাকার বাসায়। বেড়াচ্ছে। আসবে দু-একদিন পর। কেনো?
প্রেমা সরাসরি বলে,
---------নিশুতি প্রায়াণ ভাইয়ার সাথে তাইনা? তারা কোথায় আছে?
ইফতি অবাক হয়ে যায়। কি উত্তর দিবে এখন সে! ভেবেও পাচ্ছে না।
প্রেমা আবার বললো,
---------বলো। আমার থেকে লুকিয়ে রেখো না প্লিজ। বাসায় সমস্যা হচ্ছে আমাদের।
ইফতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
--------প্রায়াণ ভাইয়া আর নিশুতি সিলেট আছে।
কথাটা শুনে প্রেমা একটুও চমকায় না৷ সে যেন জানতোই এমন কিছু।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে বললো,
----------ওখানে কেনো?
ইফতি বলে,
----------আমি নিজেও জানিনা কিভাবে প্রায়াণ ভাইয়া ওখানে। যাওয়ার কথা ছিল একা নিশুতির। কিন্তু কয়েকদিন বাদে নিশুতিই জানায় ওখানে প্রায়াণ ভাইয়াও নাকি আছে ওর সাথে।
-------ওহ।
---------হুম আপু।
মিনু শেখের চিল্লাচিল্লি শোনা যায় হঠাৎ করেই। প্রেমা অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢোকে তার। ইফতি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রয়।
প্রেমা ঢুকেই দেখে টিভি তে খবরে প্রায়াণ ও নিশুতির ছবি দেখাচ্ছে।
খবর টা এরকমঃ
সিলেটে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে অবিবাহিত যুবক যুবতীর একসাথে বসবাস। হাতে নাতে ধরা...
আর সেখানে প্রায়াণ নিশুতির ছবিও আছে।
মিনু শেখ ফোনে প্রত্যুষ কে বলেন,
-------তুই খবর দেখছিস?? ঐ মেয়ের জন্য আমার ছেলেটা এভাবে মান সম্মান খোয়ালো!! আমাদের কথাও ভাবলো না একবার? তুই এখনি বাসায় আয় বাবা। আমার শরীর ভালো লাগছে না। তোর বাপকেও খবর দে এখুনি।
--------আম্মু শান্ত হও। আমি আসতেছি। তুমি শান্ত হও।
মিনু শেখ আর কথা বললো না। ধপ করে সোফার উপর বসে পড়লো। তাকে ধরলো প্রেমা। বাসায় আর কেউ নেই। প্রেমা মনে মনে বিরবির করে বললো,
---------এটা তুমি কি করলে ভাইয়া!! কি করলে!!
.
.
ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে নিশুতি। একটা অফিসে নিয়ে এসেছে তাদের। ওখানে তাবু টানিয়ে যারা যারা ছিলো,তাদের কেও নিয়ে আসা হয়েছে। প্রায়াণ কে ডেকে নিয়ে গেছে তারা। এখনো নিশুতির মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো!!
কিছুক্ষণ বাদে প্রায়াণ আসে। সাথে দুজন লোক। প্রায়াণের মুখ ফ্যাকাশে। থমথমে গলায় প্রায়াণ বললো,
--------এখুনি বিয়ে করতে হবে আমাকে। পারবা?
নিশুতি উত্তর দেয় না। শুধু মাথা কাত করে। প্রায়াণ ঐ লোকদের একজনের নাম্বার দিয়ে তার এক বন্ধুকে ফোন করে যার বাড়ি সিলেটেই।
পাক্কা চল্লিশ মিনিট পর তার বন্ধু আসে। ঢাকা থেকেও আসে দুজন বন্ধু গাড়ি নিয়ে আরো পরে।
সন্ধ্যার দিকে কাজী অফিসেই একদম সিম্পালের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। ঐ লোকেরা তবুও কিছু টাকা রাখে প্রায়াণের থেকে। এরপর ছেড়ে দেয় তাদের।
বন্ধুদের সাথে আনা গাড়িতে করে প্রায়াণ নিশুতি রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে।
নিশুতি চুপ করে বসে আছে। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে তার। প্রায়াণ যদিও চেষ্টা করছে নিশুতির সাথে কথা বলার,কিন্তু নিশুতি বলছে না কোনো কথা। আচ্ছা,এই সম্পর্কের শেষ পরিণতি কি হবে? প্রায়াণ আর নিশুতির সংসার জীবন শুরু হলো? নাকি ভালোবাসার জীবনের এখানেই শেষ?
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)