রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১৫)


--------নিশু
নিশুতি পেছন ফিরে তাকায়। তার চোখে স্পষ্ট পানি। প্রায়াণের কলিজা টা আবার ধক করে উঠে। উফ,এই কলিজা টাও না। কাজে অকাজে ধক ধক করে!! ডিজগাস্টিং!!
প্রায়াণ বুকে হাত চেঁপে ধরে নিশুতির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুর্বল গলায় বললো,
---------কাঁদছো কেনো? কি হইছে?
নিশুতি প্রায়াণের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। চাপা কান্নার আওয়াজে চারিপাশ ভারি হয়ে উঠে। প্রায়াণ আকস্মিক ঘটনায় হতবাক। শুধু নিশুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মৃদু ভাবে। একটা সময় নিশুতির কান্না আপনা আপনি কমে আসে। নিশুতি মাথা তুলে তাকায়। চোখের পানি আর নাকের পানিতে প্রায়াণের শার্ট ভিজে একাকার। প্রায়াণ খাপছাড়া দৃষ্টিতে নিশুতির দিকে তাকায়। নিশুতি স্মিত হেসে বললো,
---------সরি।
প্রায়াণ আঙুলের ডগা দিয়ে নিশুতির ফোলা চোখ দুজোড়ার আশপাশ মুছতে মুছতে বলে,
---------কাঁদছিলে কেনো?
নিশুতি ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো,
---------স্বপ্নে আম্মুকে দেখছিলাম। সেই এক্সিডেন্ট, সেই আম্মুর মৃত লাশ এসব...তাই।
প্রায়াণ বুঝতে পারে নিশুতি তাহলে এতক্ষণ তার মায়ের কথা আওড়াচ্ছিল। অজানা একটা প্রশান্তিতে বুক ভরে যায়। সেই প্রশান্তি সে প্রকাশ করে না। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলে,
----------একদিন সবাইকেই চলে যেতে হবে নিশুতি। কেউ আগে যায়,কেউ পরে। বাট যায় তো! তাহলে? এভাবে কান্না করলে হবে? হবে না। বরং নামাজ পড়ো। মায়ের জন্য দোয়া করো।
নিশুতি শরীর কাঁপছে। সে দাড়াতে পারছে না একটুও। ধপ করে ঠান্ডা ফ্লোরেই বসে পড়ে৷ প্রায়াণ নিশুতিকে টেনে ধরে,
----------ঘরে চলো। ঠান্ডা ভীষণ।
নিশুতি হালকা কণ্ঠে বললো,
----------এখানেই কিছুক্ষণ বসো না।
প্রায়াণ কথা বাড়ায় না। চুপ করে নিচে বসে। নিচে বসতেই তার গা শিউরে উঠে। উফ! কি ঠান্ডা! কি শীতল!
তবুও প্রায়াণ রাও করে না। নিশুতির পাশ ঘেঁষে বসে চুপচাপ। দুজনেই চুপ। নিশুতিই হালকা আওয়াজে বলতে শুরু করে,
----------সেদিন নভেম্বর এর এরকমই একটা শীতের রাত ছিল। আম্মু নানা বাড়ি যাবে। আরজেন্ট! আমার আবার ফাইনাল পরীক্ষা সামনেই। আমি বললাম,কয়দিন পরে যাও। আমিও সাথে যাবো তোমার তখন। আম্মু মানলো না। আর আমি অতটুকুন একটা মেয়ে,আমার কথা শুনবেই বা ক্যান! বাবার অফিস থেকে ছুটি পেলো না। মা একাই রওনা হলো রাতের বাসে। তখন আবার অবরোধ। ঢাকা শহরের অবস্থা ভালো না। একটা আতংক চারিদিকে। আমি রাত জেগে পড়ছিলাম৷ তবুও মনে একটা চাপা ভয় কেমন জানি। রাত ৩ টার দিকে চোখ লেগে আসে। কেউ ফোন করছিল বাবার নাম্বারে। আমি আধো ঘুমেই শুনলাম বাবা ডাকছে আমায়। বললো,বাহিরে যাচ্ছে। আমি যেন দরজা আটকে রাখি। আর কোথাও বের না হই। সকাল বেলা বাবা ফিরে আসে। কি যে ক্লান্ত তার চেহারায়! কি যে দুর্বলতা তার কণ্ঠে। আমার আর সেদিন স্কুল যাওয়া হলো না। আমি উদগ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কি হয়েছে? বাবা এতটুকুই বলতে পারলো,ঢাকা পার হতে না হতেই কারা যেন আম্মুদের বাসটায় আগুন লাগিয়ে দিছিল। আম্মু বের হতে পারেনাই বাস থেকে। বাসের ভেতরে জ্বলে পুড়ে....
নিশুতি আর বলতে পারে না। ঢুকরে কেঁদে উঠে। প্রায়াণ থতমত খায়। তার চোখেও পানি ছলছল। প্রায়াণ নিজেকে সামলায় তারপর নিশুতির দু'গাল চেপে ধরে বলে,
---------আমাদের সব থেকে প্রিয় মানুষ টাকে আল্লাহ একটু তাড়াতাড়িই নিয়ে যায়। এটা একধরনের পরীক্ষা। তুমিও এই পরীক্ষা টাই দিচ্ছো মনে করো। তাই নিজেকে শক্ত করো। তোমার আম্মু যেখানেই থাকুক,ভাববা তোমার সাথেই আছে। আর তুমি যদি এভাবে কান্না করো সে তো কষ্ট পাবে তাইনা? তাই কাঁদবে না। একদম কাঁদবে না। শুনছো?
নিশুতি ঠোঁট চেঁপে বলে,
---------হুম।
প্রায়াণ নিশুতির মুখ টা উঁচু করে তুলে বলে,
---------আর একটুও কাঁদলে আমি তোমাকে পিট্টি দিবো কিন্তু।
নিশুতি ছলছল চোখেই ঠোঁট উল্টায়। রিনরিনে কণ্ঠে বলে,
--------কচু দিবেন।
প্রায়াণ চোখ গরম করে বললো,
--------আবার আপনি?
নিশুতি জিহ্ব কেটে বললো,
--------মানে কচু দিবা। আর সাথে চিংড়ি মাছও দিও হু? কচু উইথ চিংড়ি মাছ,ভাজি করে খাবো। উমমম কুব ট্যাশ!
নিশুতির বলার ভঙ্গি দেখে প্রায়াণ হো হো করে হেসে ফেলে।
বাকি রাত টুকু তাদের গল্পতেই কেটে যায়। ফজরের আজান কানে আসতেই নিশুতি বলে,
--------অযু করেন। আজকে দুজনে একসাথে নামাজ পড়বো। পড়বেন?
প্রায়াণ বললো,
---------এখনো আমার বউ হও নাই ম্যাডাম। যখন হবেন তখন একসাথে পড়বো। আমি রিসোর্টের মসজিদে গিয়ে পড়ে নিবো। আপনি রুমেই পড়েন। আর আমাকে আর একবার আপনি করে বললে খাবেন মাইর।
নিশুতি কথার প্রসঙ্গ পাল্টায়। চোখ বড়বড় করে বললো,
---------রিসোর্টে মসজিদও আছে??
---------তো আবার কী? এটা যেন তেন রিসোর্ট না। অনেক নামী দামী রিসোর্টের মধ্যে একটা। আর অনেক খাটি মুমিনও আসে তাদের ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে। তো তারা কোথায় নামাজ পড়বে? এখানে সব ব্যবস্থা আছে। সউউউউউব।
নিশুতি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
---------ওহ আচ্ছা!
তারপর দুজনেই উঠে যায়। প্রায়াণ বাহিরে চলে যায়। আর নিশুতি ওয়াশরুমের দিকে। অযু সেড়ে নামাজ আদায় করে নেয় নিশুতি। মোনাজাতে বারবার এটাই প্রার্থনা করে যেন এই সময় গুলো আজীবনের মতো থমকে যায়। প্রায়াণ নামের এই ছেলেটার সাথে আজীবনের মতোন যেন সে থাকতে পারে। সুখে থাকতে পারে।
নিশুতি মোনাজাত শেষে উঠে দাঁড়ায়। জায়নামাজ ভাজ করে আবার তার ব্যাগে ভরে নেয়। ভাগ্যিস বাসা থেকে জায়নামাজ টা মনে করে এনেছিল!
তারপর বসে অপেক্ষা করতে থাকে প্রায়াণের।
প্রায় ৬ঃ৩০ বেজে গেলেও প্রায়াণ আসে না। নিশুতির কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। এতক্ষণ তো লাগার কথা না! একবার দরজা খুলে লোনের এদিক ওদিক দেখে নিশুতি। কোথাও প্রায়াণের টিকি টাও দেখা যাচ্ছে না। নিশুতি অস্থির মনে আবার রুমে এসে বসে। বিছানায় উঠে পা দোলাতে থাকে অনবরত। ভীষণ মেজাজ গরম হচ্ছে তার। আজকে আসুক বেয়াদব টা। দেখে নিবে সে একদম।
ঘড়ির কাটা যখন ৮ টা পার করে,নিশুতির তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রায়াণ তাকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে গেলো নাকি! নাহ এমন ছেলে তো প্রায়াণ না। নিশুতি একবার বারান্দায় ছুটে যায়। আবার রুমে ফিরে আসে। আবার বারান্দায় ছুটে যায়,আবার রুমে ফিরে আসে। চোখ দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জ্বলছে ভীষণ। নিশুতি সিদ্ধান্ত নেয়,এবার বাইরে গিয়েই খুঁজবে প্রায়াণ কে। যেই ভাবা সেই কাজ। ওড়না দিয়ে ভালো করে মাথাটা মুড়িয়ে নেয়। তারপর দরজা খুলতেই দেখে প্রায়াণ দাঁড়িয়ে। নিশুতির বুক থেকে একটা পাথর নেমে যায় আস্তে ধীরে। কিন্তু রাগের আগুন টা বাড়তে থাকে ধীরেধীরে। নিশুতি কিছু না বলে চুপ করে রুমে ফিরে এসে বসে। প্রায়াণ আসে পিছুপিছু। নিশুতির পাশে এসে দাড়াতেই নিশুতি বললো,
---------কোথায় ছিলেন?
নিশুতির কণ্ঠে স্পষ্ট ঝাঁঝ।
প্রায়াণ কাইকুই করে বললো,
--------আমি নামাজ শেষ করে জায়নামাজের পাটিতেই ঘুমিয়ে গেছিলাম।
নিশুতি অবিশ্বাস্য চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ ইনোসেন্ট মার্কা হাসি হাসে। সেই হাসি নিশুতির সমস্ত রাগ,সমস্ত ঝাঁঝ কমিয়ে একদম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেয়। উফ! এই ছেলের হাসিতে কী এমন জাদু আছে কে জানে।
নিশুতি প্রকাশ করে না কিছু। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাগী গলাতেই বলে
---------তো এখন আসছেন কেন? ওখানেই থাকতেন। রুমে যে কেউ অপেক্ষা করছে সেটা তো আর আপনার বুঝতে হবে না।
প্রায়াণ নিশুতির সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
----------সরি।
নিশুতি অন্যদিকেই মুখ ঘুরিয়ে থাকে। প্রায়াণ আবারো বললো,
----------সরি। তুমি যা শাস্তি দিবা,তাই মাথা পেতে নিবো। পাক্কা।
নিশুতির মাথায় বুদ্ধি খেলে উঠে। সে আঁড়চোখে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে বলে,
----------পাক্কা?
প্রায়াণ মাথা নাড়িয়ে বললো,
---------হুম।
নিশুতি দুষ্টুমি হাসি হাসে। উঠে গিয়ে তার এই কয়দিনের ব্যবহৃত জামা গুলো বের করে। তারপর প্রায়াণের একহাত টেনে বাথরুমে নিয়ে যায় তাকে। জামা কাপড় গুলো বালতিতে ফেলে বলে,
---------দোকান থেকে ডিটারজেন্ট পাউডার নিয়ে আসেন। এইগুলা ধুবেন এক্ষুনি। এটাই আপনার শাস্তি।
প্রায়াণ হতবিহ্বল।
চোখ নিভু নিভু থেকে বড় হয়ে গোল টমেটো হয়ে গিয়েছে তার। নিশুতি সে চোখের ভাষা বুঝে। মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে ঢঙ্গি গলায় বলে,
---------মোটেও মজা করছি না আমি। এটাই শাস্তি আপনার। এবার যান,গিয়ে ডিটারজেন্ট পাউডার নিয়ে আসেন।
প্রায়াণ আহত গলায় বলতে নেয়,
-------নিশ....
--------চুপ।
নিশুতি ধমকে উঠে।
---------একদম চুপ। কোনো কথা শুনবো না।এটাই শাস্তি....
.
.
নিশুতি বাথরুমের সামনে "দ" ভঙ্গিতে বসে আছে। প্রায়াণ সেন্টু গেঞ্জি পড়ে আছে এখন। নিশুতির প্রথম প্রথম লজ্জা লাগলেও এখন আর লজ্জা লাগছে না। মাঝে মাঝে গলা খাকারি গিয়ে বলছে,
---------দ্রিম দ্রিম শব্দ হয়না কেন? জোরে জোরে খাচেন কাপড় গুলো। যদি পরিষ্কার না হয় তো আবার ধোয়াবো।
প্রায়াণের রাগে শরীর জ্বলছে। নিশুতির জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে দু কানের তলা বাজিয়ে দিতো শিউর। কিন্তু নিশুতিকে কিছুই বলতে পারছে না আর কখনো পারবেও না বোধহয়। এইজন্যেই তো মানুষ বলে,বাঘ ও বাঘিনীর সামনে বিড়াল হয়ে যায়।
প্রায়াণ এবার শব্দ তুলে আছাড় মারে কাপড় গুলো। নিশুতি আবার ধমকে উঠে।
--------এটা হোটেল।মানুষ কি বলবে? এতো শব্দ করছেন কেনো? আস্তে আস্তে...
প্রায়াণ চোখ পাকিয়ে তাকায় নিশুতির দিকে। নিশুতি মুখ টিপে টিপে হাসে। প্রায়াণ মনে মনে ভাবে,আজকের রাত টা হোক,এই হিসেব সে নিয়েই ছাড়বে নিশুতির থেকে...
চলবে...

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)