রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১৮)


একটা বড় পাথরের উপর বসে রোদে দুজনের শরীর শুকিয়ে নিচ্ছে দুজনেই। নিশুতি হাপাচ্ছে খুব। পানি নিয়ে খুব দাপাদাপি করেছে এতক্ষণ। প্রায়াণ মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
---------বলেছিলাম এতো বেশি দাপাদাপি করিও না। কে শুনে আমার কথা! এখন হাপাচ্ছো তো ঠিকি!
নিশুতি উত্তর দিলো না। শুধু মুখ ভেংচি দিলো প্রায়াণ কে দেখিয়ে।
প্রায়াণ আহাজারি করে বললো,
---------এই যে মুখ ভেংচালে না? ধম্মে সইবে না হুহ!!
নিশুতি এই কথার উত্তরেও কিছু বললো না। আবারো মুখ ভেংচি কাটে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে। প্রায়াণ ও হাসে। নিশুতি হাসতে হাসতেই পেটে হাত চেপে বলে,
---------খুব ক্ষিদে লাগছে।
----------একটু জামা কাপড় গুলো শুকিয়ে নাও তারপর আমরা খাওয়ার আয়োজনে যাবো।
----------কিন্তু আমার সাথে তো কাপড় আছে। তোমার সাথেও তো আছে!
প্রায়াণ ভুলেই গিয়েছিল যে তারা রিসোর্ট থেকে সব কিছু নিয়ে এসেছে তাদের। প্রায়াণ জিভ কেটে বলে,
---------সরি ভুলে গেছিলাম। ব্যাগ কই আমাদের?
নিশুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঙুল উচিয়ে দেখায় একটু দূরে থাকা ব্যাগ গুলো কে। প্রায়াণ দায়সারাভাবে হেসে বলে,
----------বুড়ো হয়ে গিয়েছি তো। অনেক কিছুই মনে থাকে না আর!
প্রায়াণ উঠে গিয়ে ব্যাগ দুটো নিয়ে আসে। তারপর নিশুতিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
---------চলো।
নিশুতি উঠে দাঁড়ায়।
প্রায়াণ বলে,
---------এখান থেকে ৭-৮ মিনিটের দুরত্বে একটা রেস্তোরাঁ আছে। ভালো মানের। সেখানেই যাওয়া যাক।
নিশুতি বলে,
--------আচ্ছা।
তারপর দুজনেই হেটে যাত্রা শুরু করে। রেস্তোরাঁতে আসার পথে একটা খোলা জায়গা চোখে পড়ে নিশুতির যেটা ঢালু হয়ে পান্থুমাই ঝর্ণার দিকে চলে গেছে। নিশুতি উৎসুক হয়ে বললো,
---------এটা কী?
প্রায়াণ খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে বলে,
---------একটা খোলা জায়গা। দেখছোই তো!
নিশুতি বিরক্ত হয়ে বলে,
-----------উফ। আমিও তো দেখতেছি সেটা। এখানে কি হয় বা এটা কি কোনো ঘোরার জায়গা সেটা জিজ্ঞেস করলাম!!
-----------নাহ তেমন কোনো ঘোরার জায়গা না। এখানে মানুষ তাবু টানিয়ে রাতের পান্থুমাই শহর টাকে উপভোগ করে আর কি। এটা পান্থুমাই ঝর্ণার ই একটা অংশ বলতে পারো।
---------ও আচ্ছা!
নিশুতির চোখ চকচক করে উঠলো। সে আহ্লাদী কণ্ঠে বললো,
---------আমরাও তো এখানে তাবু টানিয়ে থাকতে পারি তাইনা??
প্রায়াণ সোজাসাপ্টা ভাবে বললো,
----------না। তুমি একটা মেয়ে আর আমি একটা ছেলে।
নিশুতি মুখ গোমড়া করে বললো,
----------আচ্ছা।
.
.
গরম ভাতের সাথে ২৯ পদের ভর্তা দেখে নিশুতি যারপরনাই অবাক। এতো ভর্তা সে তার বাপের জন্মেও দেখেনি।
সে ফিসফিস করে প্রায়াণ কে বললো,
--------এতো ভর্তা অর্ডার করেছো কেনো! আমরা খাবো কিভাবে!
প্রায়াণ হেসে বললো,
---------এখানে যারা খেতে আসবে সবাইকে এটা পরিবেশন করা হয়। সবাই তো আর সব খেতে পারে না। যার যেটা ইচ্ছা সে সেটা নিয়ে খায়। এবং সেই অনুযায়ী বিল পে করে। বুঝছো?
নিশুতি ঠোঁট উল্টে বললো,
--------ওওও আচ্ছা।
নিশুতি নিলো ডিম আর ধুনিয়া পাতার মিক্স একটা ভর্তা আর প্রায়াণ নিলো শুটকি ভর্তা। পেটপুরে খেলো দুজনে।
তারপর বিকেল টা পান্থুমাই গ্রাম ঘুরে কাটালো তারা।
নিশুতি যাই দেখতে,তাতেই অবাক হচ্ছে। এ যেন এক নতুন প্রকৃতি, নতুন কালচার, নতুন মানুষ জন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। আকাশের নীলিমা নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে ঢেকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
নিশুতি একটা চুড়ির দোকানের সামনে দাঁড়ানো। প্রায়াণ তাকে এখানে রেখে কোথাও যেন গিয়েছে কিছু কিনতে। নিশুতির মেজাজ গরম হচ্ছে ভীষণ। কিছুক্ষণ বাদেই প্রায়াণ ফিরে আসে। হাতে তার বড় ব্যাগ। নিশুতি কিছু প্রশ্ন করার আগেই প্রায়াণ বললো,
-------চুড়ি পছন্দ করেছো? কোনটা কিনবা বলো?
নিশুতি হা হয়ে বললো,
--------কিসের চুড়ি? তুমি আমাকে বলছিলা কোনো চুড়ি পছন্দ করতে?
---------তো তোমাকে চুড়ির দোকানের সামনে রেখে গেলাম কি করতে! যে বসে বসে চুড়ি পছন্দ করবা তাইনা?
নিশুতি মুখ কালো করে বললো,
--------আমি কোনো চুড়ি ফুড়ি পছন্দ করিনি।
প্রায়াণ আতংকিত চোখে এদিক ওদিক তাকায়। নিশুতির একদম পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলে,
---------ফুড়ি বলে না সোনা। ফুড়ি মানে মেয়ে। এটা এখানের আঞ্চলিক ভাষা। আবার পড়ে লোকে ভাব্বে আমরা মেয়ে পাচারকারী!! বেদম কিলান কিলাবে তখন। তোমাকেও আমাকেও।
নিশুতি বিরক্তি নিয়ে বললো,
-------আচ্ছা আর বলবো না।
প্রায়াণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর দোকানের ভেতর ঢুকে নিজে পছন্দ করে এক ডজন কালো চুড়ি কিনে দেয় নিশুতি কে। নিশুতির বেশ পছন্দ হয়। তারপর দুজনে আবার হাটা ধরে।
হাটতে হাটতে সেই রেস্তোরাঁয় আসে দুজন। যেখানে দুপুরের খাওয়া সেড়েছিল। সেখান থেকেই রাতের খাবার খেয়ে নেয় তারা। তারপর সেই খোলা জায়গায় যায়।
নিশুতি হাসফাস লাগিয়ে দেয়। টেনে টেনে বলে,
--------- আমি আর হাটতে পারবো না আল্লাহ। আমার ঠ্যাং ব্যথা করতেছে।
প্রায়াণ বললো,
--------আর হাটতেও হবে না। এখানেই বসো। যা করার আমিই করছি।
নিশুতি নিচে বসে পড়ে ঘাসের উপরে। বসতেই আবার লাফিয়ে উঠে। প্রায়াণ ইশারায় বলে, "কী?"
নিশুতি দায়সারাভাবে হেসে বলে,
--------ঘাসের উপর শিশির জমেছে। অনেক ঠান্ডা।
প্রায়াণ হাসলো নিশুতির কথা শুনে। শেষমেশ নিশুতির আর বসা হয় না। সে দাড়িয়েই থাকে। আর প্রায়াণ দ্রুত দ্রুত কাজ সাড়ে।
.
তাবু দেখে নিশুতির মুখ হা হয়ে যায়। সে কি কোনোদিনও ভেবেছিল কোনো একরাতে এত সুন্দর জায়গায় খোলা আকাশের নিচে তাবু গেড়ে সে শুয়ে থাকবে!!
জীবন ভীষণ রহস্যময় আর মানুষকে তার রহস্য দিয়ে অবাক করে দিতে যেন ভালোই লাগে তার।
নিশুতিও অবাক সাথে খুশিও। সে প্রায়াণ এর এক হাত চেপে বললো,
----------তুমি না বলছিলা তাবু করবে না তাহলে??
প্রায়াম মৃদু হেসে বলে,
----------আরে ওটা বললে তো তুমি জানতেই তাহলে সারপ্রাইজ হতো না আর। এই জন্য তখন ওটা বলেছি। আর আশেপাশে দেখো,আমাদের মতো আরো কত তাবু আছে এখানে।
নিশুতি আশেপাশে খেয়াল করে। জায়গা টা বেশ খোলা আর বড় হওয়ায় অনেক দূরত্ব রেখে রেখে এক একটা তাবু গাড়া। প্রতিটার ভেতরেই লাইট জ্বলছে। মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ নিশুতির চোখেই পড়েনি এসব। নিশুতি আরো খুশি হয়ে যায়। যাক,তারা তাহলে এখানে একা না। তাদের মতো আরো অনেকেই আছে!
.
.
রাত বাড়ছে। সাথে ঠান্ডাও। বাজার থেকে কিছু শুকনো লাকড়ি কিনে নিয়ে এসেছিল প্রায়াণ। তাই দিয়ে আগুন জ্বালায় সে তাবুর বাহিরে। নিশুতি আগুনের পাশেই গুটিশুটি মেরে বসে। ঠান্ডায় তার জমে যাওয়ার মতো অবস্থা।
প্রায়াণ তার অবস্থা দেখে বললো,
---------ঢাকায় থাকো তো তাই ঠান্ডা কি জিনিস টের পাও না। যারা পার্বত্য এলাকায় থাকে তারা বোঝে ঠান্ডা কি জিনিস।
নিশুতি কাঁপা ঠোঁট নিয়ে বললো,
--------আজকে আমি ঠান্ডায় মরে যাবো। আর আমার পোস্ট মর্টামে লেখা থাকবে সব তোমার দোষ। কে বলছিল আমাকে এই খোলা আকাশের নিচে রাখতে। আল্লাহ গো। খোদা গো। মাবূদ গো...
প্রায়াণ ভ্রু কুঁচকে বলে,
--------যা বাবা!! তুমিই না প্রথমে বলছিলা তাবুর কথা!!
--------আমি কি জানতাম এতো ঠান্ডা পড়ে রাতে। রিসোর্টেও তো বোঝা যায়নি। তুমি আমাকে বলবা না ঠান্ডার কথা।
প্রায়াণ বিরবির করে বললো,
--------যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর!! এখন সব আমার দোষ হয়ে গেলো। বাল!
নিশুতি জোরে চিল্লিয়ে বললো,
--------হু বাল। ব আকার ল বাল।
বলতে বলতেই ঘাসের উপর ধুম করে শুয়ে পড়লো। আকস্মিক ঘটনায় প্রায়াণ হতবাক। কি হলো এটা!
প্রায়াণ দ্রুত নিশুতির পাশে এসে তাকে ধাক্কা দেয়।
---------নিশুতি....নিশু...এই নিশু...
নিশুতি গভীর ঘুমে। প্রায়াণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাজাকোল করে নিশুতিকে তুলে তাবুর ভেতরে শুইয়ে দেয়। তারপর নিজে এসে কতক্ষণ আগুন পোহায়। তারপর নিজেও তাবুর ভেতর চলে যায়।
.
.
রাত বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে ঠকঠক করে কাপছে নিশুতি। যদিও গায়ের উপর অনেকটা মোটাসোটা কম্বল দেওয়া তার। যেটা সন্ধ্যায়ই কিনেছে প্রায়াণ। তবুও নিশুতি কাপছে। প্রায়াণ ব্যাগ থেকে তার মোটা জ্যাকেট টা বের করে নিশুতির গায়ের উপর দিয়ে তার উপর কম্বল চাপা দেয়। নিশুতি তবুও কাপছে। প্রায়াণ সাতপাঁচ ভেবে নিজেও কম্বলের ভিতর ঢুকে পড়ে। ইতস্তত করলেও নিশুতিকে শক্ত করে চেপে ধরে। একদম শক্ত করে। যেন তাদের দুজনের ভেতর থেকে বাতাস টাও না যাওয়া আসা করতে পারে।
.
নিশুতি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ প্রায়াণের চোখে ঘুম নেই। সে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট এর আলোয় নিশুতির ঘুমন্ত চেহারা খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত। আচ্ছা,এখন যদি নিশুতির ঐ এলো চুলের আড়ালে থাকা কপালে প্রায়াণ একটা অধর স্পর্শ বসিয়ে দেয়,তবে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)