রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১১)


শানের হুট করেই মন খারাপ হয়ে যায়। বিরবিরিয়ে বলে,
--------প্রায়াণ ইউ আর লাকি ম্যান!
নম্রতার কান অব্দি সে কথা পৌঁছায় না। সে হাতঘড়ি দেখে। সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। আর থাকাটা ঠিক হবেনা। সে শানের দিকে ফিরে বলে,
--------আজ আসি। আবার কোনোদিন আসলে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ।
শান মুখে বিষন্নতার হাসি ফুটায়। বলে,
--------আল্লাহ হাফেজ।
নম্রতা দুলদুলে পায় চলে যায়। শান তার যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটা যেন সুখী হয়,শান মনে মনে প্রার্থনা করে।
.
.
.
নিশুতি মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। প্রায়াণ বিছানায় বসা ছিল। নিশুতিকে বের হতে দেখে সে তার দিকে এগিয়ে আসে। একটা প্রশ্ন সেই কখন থেকে খচখচ করছে মনের ভেতর।
--------নিশু,কালকে ওভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলা কেন?
নিশুতির মনে পড়ে যায় কাল রাতের ঘটনা। এতক্ষণ এত শোকের মধ্যে সেসব তো প্রায় ভুলতেই বসেছিল সে।
সে প্রায়াণের দিকে সরু চোখে তাকায়। প্রায়াণ শান্ত চোখে নিশুতির দিকে তাকিয়ে আছে।
--------সত্যি বলবো?
প্রায়াণ কপাল কুঁচকায়।
-------সত্যি টাই বলো। কেন অজ্ঞান হইলা?
নিশুতি প্রায়াণের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মিথ্যা বাহানা না করে সত্যি বলাই শ্রেয় মনে হচ্ছে তার কাছে।
নিশুতি দায়সারাভাবে বললো,
-------কালকে রাতে আমি আপনাকে কারো সাথে কথা বলতে শুনেছি। মেবি আপনার গার্লফ্রেন্ড। জানিনা কেন,ব্যাপার টা ভীষণ করে গেথে যায় মাথায়। এটা সেটা নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। আর আমার আবার এক সমস্যা আছে। বেশি প্রেসার নিতে পারিনা। সেন্সলেস হয়ে যাই। আর তাই কালকেও....
প্রায়াণ নিশুতির দিকে এগিয়ে আসে। নিশুতি চুপ হয়ে যায়। বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে গেছে তার। প্রায়াণ আচমকাই নিশুতির কাধের হাত উপর হাত রাখে। নিশুতি মাথা নিচু করে ফেলে। প্রায়াণ হাত দিয়ে নিশুতির থুতনি উঁচু করে। তবুও নিশুতি প্রায়াণের দিকে তাকায় না। তার দৃষ্টি অন্যদিকে। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার।
প্রায়াণ শান্ত গলাতেই বলে,
--------ডু ইউ লাভ মি নিশু??
নিশুতির কান লাল হয়ে যায় লজ্জায়। সে তো নিজেই জানেনা সে তাকে ভালোবাসে কিনা তাহলে সে প্রায়াণ কে জবাব দিবে কিভাবে!
প্রায়াণ আবারও বলে,
-------ডু ইউ লাভ মি নিশু? প্লিজ বলো আমাকে।
নিশুতি প্রায়াণের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বারান্দার দিকে দৌড় মারে। আর এক মুহুর্ত প্রায়াণের সামনে থাকা মানে আবারও জ্ঞান হারানো। উফ!! তার জ্ঞান টাও যে কী না!! একটুতেই হারিয়ে যায় খালি।
প্রায়াণ পিছু এসে দাঁড়ায়। সে আজ নিশুতির মুখ থেকে ইয়েস-নো.....কিছু একটা শুনে তারপর দম নিবে।
প্রায়াণ নিশুতির ঠিক পিছে দাঁড়িয়ে বলে,
-------ঠিক আছে। মুখে বলতে হবে না। যদি আমাকে লাভ করো তাহলে আমার হাত টা ধরবে শুধু। আর যদি না করো,তাহলে ধরবে না। আর আমি এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যাবো।
প্রায়াণ সাময়িক বিরতি নেয় কথার মাঝে। তারপর আবার বলে,
-------আমি যাচ্ছি তাহলে। নিজের খেয়াল রাখিও?
প্রায়াণ পেছন ফিরে চলে যেতে নেয়। কিন্তু কিছু একটা তাকে টান দিয়ে ধরে। প্রায়াণ থমকায়। চমকে পেছনে তাকায়। নিশুতির এক হাত তাকে আটকে ধরে আছে। নিশুতির চোখে পানি।
ধরা গলায় বলে,
-------প্লিজ যাইয়েন না।
প্রায়াণ এর বুকে খুশির ঢেউ। তাহলে নিশুতিও তাকে....ইশ!!
প্রায়াণ হঠাৎ করেই নিশুতিকে বুকে চেপে ধরে। নিশুতিও আঁকড়ে ধরে প্রায়াণ কে। এই বুকে এত শান্তি.....এত আদুরে পরশ! যেমন টা মায়ের বুকের ভেতর থাকে।
নিশুতি প্রায়াণের বুক থেকে মুখ তুলে বলে,
--------কিন্তু কালকে কে ফোন করেছিলো??
প্রায়াণ নিশুতিকে ছেড়ে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
--------আমার বাগদত্তা। যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
--------হোয়াট!!!
নিশুতির কন্ঠে ভারী বিষ্ময়।
প্রায়াণ মৃদুস্বরে বলে,
--------আমার আম্মুর বান্ধবীর মেয়ে। ছোট বেলা থেকেই নাকি আমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল একে অপরে। কিন্তু বিশ্বাস করো নিশু,আমি ওকে কোনোদিন আমার ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য চোখে দেখিনি।
নিশুতি একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। নিচু গলায় বলে,
--------নাম কী?
--------নম্রতা।
--------ওহ!
নিশুতির আকাশপানে মুখ করে তাকায়। বড্ড বিরক্ত সে জীবনের এসব সময়গুলোর জন্য। আচ্ছা,সহজ উপায়ে কোনোকিছুই কি তার হবার নয়?
প্রায়াণ নিশুতির মনের অবস্থা বুঝতে পারে। নিশুতির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
--------আমি আম্মুকে বলবো তোমার কথা। আম্মু মেনে নিবে তোমাকে দেইখো। তুমি শুধু শুধু ভাবছো! সব ঠিক হয়ে যাবে নিশু।
নিশুতি উদাসী গলায় বলে,
--------তাই যেন হয়।
.
.
.
ইফতি গেইট খুলে বের হতেই প্রেমা তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
--------ইফতি, নিশুতি কই?? ওকে দেখিনা যে এখন! ছাদেও যায়না।
ইফতি থতমত খায়।
মিনমিনে স্বরে বলে,
-------কাকার বাসায় বেড়াতে গেছে।
ইফতি এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না আর। তরতর করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। প্রেমা নাক মুখ কুঁচকে বলে,
-------কখনো তো ওকে স্কুলেও ঠিকঠাক যেতে দেয়নি ওর মা কাজের কারনে। আর এখন কাকার বাসায় বেড়াতে গেলো! স্ট্রেঞ্জ!
প্রেমা একটা লম্বা দম ফেলে যেই না ঘরের দরজা আটকাতে যাবে ওমনি নম্রতা আসে। প্রেমা হেসে বলে,
-------আরে! নম্রতা আপু। তুমি??
-------হ্যাঁ আমি।।ভেতরে আসতে দিবিনা?
-------আরে আসো আসো!
প্রেমা দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। নম্রতা ঢুকে খুব ধীরে সুস্থে।
পিউ দৌড়ে আসে।
--------আম্মু দেখো কে এসেছে।
মিনু শেখ ড্রয়িং রুম থেকে দ্রুত আসেন। নম্রতাকে দেখে তার মুখেও হাসি ফুটে উঠে।
-------আরে নম্রতা যে! এসো মা এসো। তোমার আম্মু ইদানীং আসে না কেনো হুম?? তাকে বলে দিও,আমি কিন্তু ওকে গুলি করে মারবো।
নম্রতা হেসে ফেলে।
-------বাসায় ছোট কাকারা বেড়াতে আসছে। তাই আম্মুর ভীষণ ব্যস্ততা। ব্যস্ততা চলে গেলেই আসবে আপনার বাসায় আন্টি।
-------ওহ আচ্ছা!
নম্রতা সোফায় বসে। মিনু শেখ প্রেমা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
--------রঙ চা বানা যা।
---------এখুনি যাচ্ছি আম্মু।
প্রেমা যেতে নিতেই নম্রতা বলে,
-------নাহ। দুধ চা দিও।
মিনু শেখ অবাক হন।
-------দুধ চা? তুমি না সবসময় রঙ চা খেতা! এখন হঠাৎ দুধ চা??
-------প্রায়াণ তো রঙ চা একদম সহ্য করতে পারেনা। ওর সাথে থাকতে হলে আমাকেও ওর মতোই থাকতে হবে তাইনা আন্টি? তাই এখন থেকেই দুধ চা খাওয়ার অভ্যাস করছি।
কথার মাঝে ফোড়ন কাটে পিউ।
-------কে বলছে? এইতো কয়েকদিন আগে নিশুতি আপু রঙ চা দিয়ে গেছিলো। ভাইয়া তো ঠিকই সবার আগে এক কাপ খেলো!
মিনু শেখ ধমকে উঠেন।
--------বড়দের মাঝে কথা বলতে নেই পিউ। তুমি তোমার রুমে যাও।
পিউ মুখ ভেংচে উঠে পড়ে।
নম্রতার মাথায় কথাটা গেথে যায়। সে মিনু শেখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-------আন্টি নিশুতি কে??
--------ঐ তো পাশের বাসায় থাকে। কেনো?
--------নাহ এমনি।
নম্রতা কোনোদিন নিজের কসম কাটিয়েও প্রায়াণ কে রঙ চা খাওয়াতে পারেনি এক কাপ। আর এখন অন্য এক মেয়ের বানানো চা....!
নম্রতার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
.
.
আসার আগে আগে মিনু শেখ কে বারান্দায় ডাকে নম্রতা। মিনু শেখ আসতেই বলে,
--------আন্টি প্রায়াণ কোথায় গেছে?
--------বরিশাল। স্পোর্টস টিমের সাথে। তোমাকে বলেনি ও?
--------বলেছে।
--------তাহলে??
---------এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আজকে আসি তবে??
---------রাতের খাবার খেয়ে যাও...
--------আজ না আন্টি। অন্যদিন।
নম্রতা চলে যায়। মনে তার একগাদা খচখচানি। এই নিশুতি মেয়েটাকে তার দেখতে হবে। কে এই মেয়ে!
.
.
নিশুতি 'দ' ভঙ্গিতে বসে আছে। কিছুই ভাল লাগছে না তার। একটার পর একটা মন খারাপের মুহুর্ত!! জীবন টা বিষাদময়!!
প্রায়াণ নিশুতির মন টা ঠিক করতে চায়। নিশুতির পাশে বসে বলে,
--------বিছানাকান্দি ঘুরতে যাই চলো।
নিশুতি প্রথমে রাজি না হলেও প্রায়াণের জোরাজুরি তে রাজি হয়ে যায়। পোশাক বদলে একটা মিষ্টি কালারের লং থ্রিপিস পরে নেয়। দেখতে একটা মিষ্টি পরী লাগছে যেন। প্রায়াণ আসমানী কালারের একটা শার্ট পরেছে সাথে হোয়াইট প্যান্ট। নিশুতি আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়ানোর সময় বারবার আঁড়চোখে দেখেছে প্রায়াণকে। মনে মনে ভাবে,এক্ষুনি একটা ক্রাশ খেয়ে ফেললে কেমন হয়?
.
.
মুখটা হা করে দাঁড়িয়ে আছে নিশুতি। পৃথিবীতে এর সুন্দর জায়গা আছে!! তা বিছানাকান্দি তে না আসলে জানতোই না নিশুতি। আকাশের নীলের সাথে নিচে নীল পানি৷ দুজনে পাল্লা লাগিয়েছে যেন কে কত বেশি নীল বর্ণ ধারণ করতে পারে। কাছের পাহাড় গুলো সবুজ,একটু দূরের গুলো নীল আর খুব দূরের গুলো গাড় নীল।
প্রায়াণ আঁড়চোখে নিশুতির অবস্থা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসে। সে জানতো এখানে এলে মেয়েটার মন খারাপ থাকতেই পারবে না।
-------কেমন লাগছে বিছানাকান্দি নিশু??
নিশুতি জবাব দেয় না। তার মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছে না। সে বাচ্চাদের মতো হাত পা ছোটাছুটি করে। এদিক থেকে ওদিক,আবার ওদিক থেকে এদিক, দৌড়াদৌড়ি করছে নিশুতি। প্রায়াণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটা আসলেই একটা বড় রূপী বাচ্চা।
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)