রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ২২)


প্রেমা পিউ ফুল নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যুষ ওদের ডাইরেকশন দিচ্ছে বেড সাজানোর ব্যাপারে। প্রায়াণ একবার রুমে ঢুকতে চাইলে প্রত্যুষ ধমকে উঠে,
"এই ব্যাটা তুই এখানে এসে কি করবি?"
"আমার বাসর ঘর কিভাবে সাজাচ্ছো সেটা দেখবো না!"
প্রত্যুষ চোখ গোল গোল করে বললো,
"তর কি একটুও লজ্জা শরম নাই? নিজের বাসর ঘর নিজে সাজাইতে চাস! বেয়াদব। যা এইনতে.."
প্রায়াণ ধমক খেয়ে ফিরে আসে। গজগজ করতে করতে এসে ড্রয়িংরুমে বসে। নিশুতি আগে থেকেই ওখানে বসা ছিল। কিছুক্ষণ বাদে নাকি পার্লার থেকে লোক আসবে। নিশুতিকে বউ সাজাতে৷ সেই অপেক্ষায় আছে নিশুতি।
প্রায়াণ কে দেখে মুচকি হেসে বলে,
"আসলেই তোমার কান্ডজ্ঞান নেই? নিজের বাসর ঘর কেউ নিজেই সাজাতে যায়! বলো।"
"আমি চাই। ওরা যদি ঠিকঠাক ভাবে না সাজায় তখন? পুরো বাসর রাত টাই নষ্ট হবে!!"
"বাসর ঘর সাজানোতে বুঝি বাসর রাত কেমন হবে সেটা নির্ভর করে?"
প্রায়াণ ভ্রু কুঁচকে বললো,
"তো?"
নিশুতি অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে,কিছুটা লজ্জা মাখা গলায় বলে,
"তুমি কি আমাকে আদর করাতে ব্যস্ত থাকবা নাকি বাসর ঘর খুটিয়ে দেখতে!"
প্রায়াণ থতমত খায়। নিশুতি নিজেই কথাটা বলে জিভ কাটে বারংবার। ইশ! কিই না বলে ফেললো সে! এই নির্লজ্জের সাথে থাকতে থাকতে নিজেরও লজ্জা কমে আসছে বোধহয়।
প্রায়াণ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠে। নিশুতি পড়িমরি করে উঠে যায়। একটা তো অজুহাত পাওয়া গেলো। এই লজ্জাজনক অধ্যায় থেকে নিজেকে বাঁচানোর!
দরজা খুলতেই ইফতি তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢোকে। অনেকদিন পর ভাইকে দেখে নিশুতির চোখে জল ছাপিয়ে উঠে ধীরে ধীরে। কিন্তু অভিমানী স্বরে বলে,
"না আসলেও পারতি! সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। এখন সময় হলো বুঝি আসার"
ইফতি কান ধরে দুহাতে। অনুনয়ের সুরে বলে,
"একটা ফ্রেন্ড এক্সিডেন্ট করছে সকালে। ওকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আর কি করে জানবো তুই আজকে আসবি! বাসায় আসার পর মায়ের থেকে সব শুনে ছুটে এলাম এখানে। সরি আপু।"
নিশুতি হাসি হাসি মুখ করে বলে,
"ইটস ওকে।"
"প্রায়াণ ভাইয়া কই?"
পেছন থেকে প্রায়াণ বলে,
"এই যে আমি।"
ইফতিকে নিয়ে সোফায় বসে নিশুতি। ইফতি অবিশ্বাসের সুরে বলে,
"এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার যে প্রায়াণের জন্য তুই বাসা থেকে পালানোর ডিসিশন নিছিলি সেই প্রায়াণই তোর হাজবেন্ড এখন!!"
নিশুতি জবাব দেয়,
"আমিও তো কখনো ভাবিনি আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো,বা তার সাথেই বিয়ে হবে আমার। বাট হয়ে গেছে!"
প্রায়াণ বলে উঠে,
"আসলে ভাগ্য কাকে কখন কোন পরিস্থিতিতে ফেলে সেটা কেউ আগাম জানে না।"
ইফতি আর কথা বাড়ায় না এই বিষয়ে। নিশুতির হাতে হাত রেখে বলে,
"যাইহোক এবার তুই সুখে থাক আপু। এটাই হলো মূখ্য চাওয়া।"
নিশুতি ইফতির চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
"যাকে ভালোবাসছি আমি তাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলাম। আমার ভাইটাও আমার পাশেই থাকবে। যখন ইচ্ছা দেখতে পারবো,কথা বলতে পারবো। আমি সুখে থাকবো না তো কে থাকবে বল!"
প্রতিউত্তরে ইফতি কিছুই বলে। দায়সারাভাবে হাসে শুধু।
কিছুক্ষণ বাদে পার্লার থেকে দুজনে মহিলা আসে। নিশুতি তাদের কে নিয়ে প্রেমার ঘরে যায়। ড্র‍য়িং রুমে বসে থাকে প্রায়াণ আর ইফতি। দুজনে কিছু কথাবার্তা বলে ইফতি বিদায় নেয়।
.
রাতের রান্না টা মিনু শেখই করে। খুব আয়োজন করে। এবং তাকে বেশ হাসিখুশিও দেখাচ্ছে। নম্রতা ও এসেছে অবশ্য কিন্তু মিনু শেখ ডেকেছে বিধায়।
যখন নিশুতির বউ সাজ শেষ, নম্রতা তাকে দেখতে যায়। এবং তাকে দেখেই নম্রতার চোখ ছাপিয়ে জলের কণা চিকচিক করে উঠে। তবুও বেশ কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখে নম্রতা। হাসিমুখে নিশুতির সাথে দুটো কথা বলে রান্নাঘরে ফিরে আসে আবার।
এসেই নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে। মিনু শেখ খেয়াল করে তা। কিন্তু নম্রতাকে স্বান্তনা দেয়না। স্বান্তনা সে আর দিবেও না। যা করবে সোজা করেই দেখাবে।
অনেক ঝামেলার পর,নিজের বোনদের কেই টিপস দিয়ে রাত সাড়ে ১১ টায় প্রায়াণ বাসর ঘরে ঢুকে। রুমের দরজা আটকে দোয়াদরুদ পড়ে নিজের বুকে নিজেই ফু দেয় বারকয়েক। তারপর মুখে হাসি রেখে নিশুতির দিকে এগিয়ে যায়।
ফুলেল বিছানায় নিশুতি এককোনায় চুপচাপ 'দ' ভঙ্গিতে বসা। প্রায়াণের আগমন বার্তা পেতেই সে নড়েচড়ে বসে। ভেতরটা কাঁপছে তার। যতই পরিচিত হোক, বাসর রাতে প্রতিটা মেয়েরই একটা আলাদা ভালোলাগা,আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
নিশুতির মনেও সেই অনুভূতিরা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে। নিশুতি খেয়াল করে তার পা দুটো তিরতির করে কাঁপছে ধীরে ধীরে। প্রায়াণের চোখে পড়বে ভেবে নিশুতি তার পাজোড়া শাড়ির ভেতরে আলগোছে ঢুকিয়ে নেয়।
.
প্রায়াণ এসে নিশুতির সামনে বসে। খ্যাঁক খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে নেয় দুইবার। যেন সে গান গাইতে শুরু করবে এখুনি!
পাতলা ঘোমটার তল থেকে নিশুতি প্রায়াণকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
প্রায়াণের ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাস লাগলেও সে নিজের ঠাঁট বজায় রাখার চেষ্টা করে চলছে অনবরত।
নিশুতি হালকা গলায় বললো,
"তুমি কি গান গাইবা?"
"কেনো?"বিষ্ময় নিয়ে বললো প্রায়াণ।
" যেভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করছো তাই আস্ক করলাম।"
প্রায়াণ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলে, "ওহ।"
তারপর আবার দুজনেই চুপচাপ। নিশুতিই বলে,
"কিছু বলবা নাকি এভাবেই চুপ করে বসে থাকবা?"
প্রায়াণ নড়েচড়ে উঠে বলে,
"হ্যাঁ বলবো তো। আসলে এই প্রথম তো বাসররাত আমার তাই একটু কেমন যেন লাগছে!"
ঘোমটার তল থেকে মুখ বের করে,নিশুতি অবাক হয়ে বললো,
"মানুষের কি বারবার বাসর রাত হয়? আমার কি দ্বিতীয় বার হচ্ছে নাকি? আজব!!"
প্রায়াণ আবারও নিজের বোকাবোকা কথার জন্য লজ্জা পায়। সে আর কোনো কথা বলে না। আস্তে আস্তে নিশুতির পাশ ঘেঁষে বসে। এবার লজ্জা চেপে ধরে নিশুতিকে। সে আবার ঘোমটার ভেতর মুখ লুকিয়ে ফেলে। স্থির হয়ে বসে থাকে।
প্রায়াণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
"আজকে আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে তোমার এই রাত টা স্মরণীয় হয়ে থাকে আজীবন।"
নিশুতি জবাব দেয়,
"প্রতিটি মেয়ের কাছেই তার বাসররাত স্মরণীয় রাত।"
"তবুও আমি একটু অন্যরকম কিছু করতে চাই।"
"ঠিক আছে। অনুমতি দিলাম।"
প্রায়াণ উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগোয়। ঠিক তখনি দরজায় কষাঘাত পড়ে। একবার দুইবার না...অনেকবার। প্রায়াণ বিরক্তবোধ করে। নিশুতি বলে,
"খুলে দেখো কে।"
"প্রেমা পিউ বোধহয়। জ্বালাতে আসছে। বাদ দাও তো।"
"আহা একবার খুলেই তো দেখো!"
নিশুতির কথায় প্রায়াণ গিয়ে দরজা খুলে। দেখে তার মা দাঁড়িয়ে।
নরম গলায় বললো,
"ডিস্টার্ব করলাম তোদের বাবা?"
"না মা! কিছু হয়েছে?এত রাতে!"
"আসলে আমার গা ব্যথা করছে খুব। ভাবলাম নিশুতিকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাই। একটু গা গতর টিপে দিবে আমার। তুই রাগ করবি নাতো? এরপর থেকে সারাজীবনের জন্য তো নিশুতি তোরই।"
প্রায়াণ কিছু বলার আগেই নিশুতি বিছানা ছেড়ে নামে। তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
"না না আন্টি। মানে মা। সমস্যা নেই। চলুন আমি আপনার শরীর টিপে দিচ্ছি।"
প্রায়াণ বাধা দেয়।
বলে,
"প্রেমা পিউ আছে তো মা! ওদের দিয়ে..."
"ওরা ঘুমাচ্ছে তো। কেনো নিশুতিকে নিলে সমস্যা??"
প্রায়াণ আর রাও করে না। নিশুতিকে চলে যায় মিনু শেখ।
প্রায়াণ বারান্দায় এসে সিগারেট ধরায়। মায়ের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু কিছু বলারও তো জোঁ নেই..
.
.
রাত ২ঃ৩০ এ নিশুতি নিজের রুমে ফিরে আসে। এতক্ষণ যাবত শ্বাশুড়ির হাত পা টিপতে টিপতে সে বড্ড ক্লান্ত। নিশুতি এসে দেখে প্রায়াণ এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে বিছানার উপর। নিশুতি আর প্রায়াণ কে জাগায় না। তার গায়ে কম্বল দিয়ে নিজেও একপাশে ঘুপটি মেরে শুয়ে পড়ে। ধীরেধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে....
.
.
সকালের মিষ্টি রোদে শহর টা ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। জানালার ফাক গলে সেই রোদ এসে পড়ে নিশুতির চোখে। নিশুতির ঘুম ভেঙে যায়। পিটপিট করে চোখ খুলতেই সে নিজেকে প্রায়াণের বাহুডোরে আবিষ্কার করে। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মনের কার্নিশ ছেয়ে যায়।
ঘুমন্ত অবস্থায় প্রায়াণ কে একটা ছোট নিষ্পাপ বাচ্চার মতো লাগে একদম। গভীর দুটি চোখে,ঘন মোটা দুটো ব্রু..মাঝে ছোট্ট একটা তিল। নাকটা বেশ মোটা। নিশুতি বিরবির করে বলে,
"সবখানে নাক গলাও বুঝি বেশি? তাই তোমার নাক গলে গলে মোটা হয়ে গেছে প্রায়াণ বাবু।"
তারপর নিজেই একা একা হেসে উঠে। চওড়া ঠোঁট দুটি চোখে পড়তেই নিশুতির লোভ লাগে৷ সে প্রায়াণের মুখের সামনে তার হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো করে কয়েকবার। নাহ,প্রায়াণের হুশ নেই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। নিশুতি সুযোগ পায়। তার বাসি ঠোঁট জোড়া দিয়ে প্রায়াণের ঠোঁটে আলতো করে স্পর্শ করতেই প্রায়াণ দু'হাতের মাঝে নিশুতিকে চেঁপে ধরে। নিশুতি চমকে উঠে। ঠোঁট সরিয়ে নেয় দ্রুত। চোখ বড়বড় করে বললো,
"তুমি ঘুমাও নি??"
"ঘুমিয়েছিলাম তো।যেভাবে ঠোঁট রেপ করতেছো আমার! তাতে আর ঘুম থাকে?"
নিশুতি লজ্জা পায়। প্রায়াণকে ঠেলে সরিয়ে দিতে নেয়। প্রায়াণ অতই নিশুতিকে নিজের মাঝে আঁকড়ে ধরে।
"তো ম্যাডাম।আমার নাক মোটা? আমি নাক গলাই খুব??"
নিশুতি জিভ কেটে বলে,
"এটাও শুনছো তুমি?"
"সব শুনছি। সউউউউব। বাজে মেয়ে,পঁচা মেয়ে। নিজের জামাইয়ের মোটা নাক নিয়ে মজা করো!"
নিশুতি মজা পায়।
আহ্লাদী গলায় বলে,
"থাক থাক। কান্না কলে না ভাবু। মেলা তেকে কেলনা কিনে দিবো তোমাকে..."
"তবে রে..দুষ্টু মেয়ে..."
প্রায়াণ বেশ শক্ত করে চেঁপে ধরে নিশুতিকে। এভাবেই চলতে থাকে দুজনের খুনশুটি বেশ কিছুক্ষণ। আবারো কড়াঘাত পড়ে দরজায়।
নিশুতি প্রায়াণ কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথায় ওড়না টেনে দরজা খুলে দেখে মিনু শেখ দাঁড়িয়ে। নাস্তা বানাতে নিশুতির সাহায্য প্রয়োজন তার। ডাকতে এসেছে তাই...
নিশুতি একবার প্রায়াণের দিকে তাকায়। তারপর চুপচাপ বের হয়ে যায় শ্বাশুড়ির সাথে। প্রায়াণ একা বিছানায় শুয়ে থাকে। সন্দেহ লাগছে তার...তার মা কি নিশুতিকে ঘরের বউ মেনে নিয়ে এসব করাচ্ছে...নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রায়াণের থেকে দূরে রাখার জন্য...!
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)