রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১৩)


আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসে প্রায়াণ। নিশুতি বিছানার পাশে অন্যদিকে ফিরে বসে বসে কিছু একটা করছে। প্রায়াণ শুধু তার পেছনের দিকটাই দেখতে পাচ্ছে৷ নিশুতির জামা টার গলা বেশ বড়। পিঠের অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে অনায়াসেই। প্রায়াণের ইচ্ছে করে ঐ ফর্সা পিঠটায় একটা চুমু খেয়ে নিতে। কিন্তু নিশুতি কি ভাবে না ভাবে! তাই নিজের ইচ্ছে কে নিজের মনেই মাটি চাপা দেয় প্রায়ান।
প্রায়াণের নড়াচড়ায় নিশুতি পেছন ফিরে তাকায়। প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে মৃদু সুরে বলে,
--------গুড ইভেনিং।
প্রায়াণ ও হাসি হাসি মুখে বলে,
--------হুম গুড ইভেনিং। কখন উঠলে?
--------আপনি উঠার ১৫ মিনিট আগে।
--------হাতে ওটা কি?
--------একটা ম্যাগাজিন। একা একা বোর হচ্ছিলাম তো,তাই পড়ছিলাম।
প্রায়াণ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-------আমাকে উঠালেই তো পারতে!
-------আপনি ঘুমোচ্ছিলেন তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।
প্রায়াণ বিরবির করে বলে,
--------পাগলি!
--------কিছু বললেন?
নিশুতির প্রশ্ন।
প্রায়াণ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
-------নাহ কিছুই না।
প্রায়াণ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। নিশুতি এই ফাকে রিসিপশনে কল করে ফেলে একবার। দুটো কফি হয়ে যাক অন্তত!
.
প্রায়াণ বের হয়ে আশেপাশে কোথাও নিশুতিকে দেখে না৷ কিছুটা চিন্তিত হয়ে নিশুতির নাম ধরে ডাকে। নিশুতি বারান্দা থেকে চওড়া গলায় বলে,
--------এই যে আমি এখানে। এখানে আসুন।
প্রায়াণ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কেন জানি নিশুতিকে এক মুহুর্তও চোখের আড়াল করতে মন চায় না তার।
বারান্দায় গিয়ে নিশুতির সামনের বেতের সোফাটায় বসে সে। বাহিরে নিকষ কালো অন্ধকার৷ চাঁদ নেই আজ। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। আজ কি বৃষ্টি হবে!
নিশুতি আকাশের দিকে মুখ করে বলে,
--------এখন তো শীতের শুরু। আর এখনো আকাশে কত মেঘ!! আজ কি বৃষ্টি হবে??
প্রায়াণ মৃদু কণ্ঠে বলে,
-------যেই দেশে আছি আমরা! এখানে মানুষের কোনো গ্যারান্টি নাই,আবার তো আবোহাওয়া!!
নিশুতি সম্মতি প্রকাশ করে বলে,
-------হুম ঠিক বলছেন। এই যে দেখুন না,এখন এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছেন আমাকে! কয়েকদিন পর তো নাও থাকতে পারে এই ভালোবাসা।
কথাটা বলেই নিশুতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকে।
প্রায়াণ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। মেয়েটা বলে কী! প্রায়াণ কে থম মেরে বসে থাকতে দেখে নিশুতি এবার জোরে হেসে উঠে। প্রায়াণের থম মারা ভাঙে৷ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিশুতির সেই হাসির দিকে। প্রাণখোলা, প্রাণবন্ত সেই হাসি। প্রায়াণ বিরবির করে বলে,
-------মাশাল্লাহ! আল্লাহ,এই হাসিটা যেন আমি সবসময় ওর মুখে দেখতে পারি। আমিন।
প্রায়াণকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশুতির হাসি থেমে যায়। লজ্জা পায় সে। নতজানু হয়ে বলে,
--------এভাবে কি দেখছেন?
প্রায়াণের তখন কি হয় কে জানে। সে নিশুতির একহাত চেপে ধরে। হ্যাচকা টানে নিশুতিকে দাড় করায়। তারপর আরেকটা হ্যাচকা টানে নিজের একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে। নিশুতির কোমড়ে প্রায়াণের হাত ঘুরাঘুরি করতে থাকে। নিশুতির তখন হার্ট বন্ধ হয় হয় অবস্থা৷সে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিহি কণ্ঠে বলে,
-------প্রায়াণ,কি করছেন আপনি? ছাড়ুন প্লিজ।
প্রায়াণ জবাব দেয় না। দুজনে এতটা কাছাকাছি চলে এসেছে যে একজনের গরম নিশ্বাসের শব্দ টাও আরেকজনের কানে বাধছে। প্রায়াণ তার মুখটা আগায়। নিশুতি চোখ বন্ধ করে ফেলে। ভালো লাগছে তার,ভীষণ ভালো লাগছে। করুক না প্রায়াণের যা ইচ্ছে,থেমে যাক না সময় এখানে। হোক না কোনো নতুন প্রণয়,যেখানে দুটি মানব মানবীর অব্যক্ত ভালোবাসা সাক্ষী হয়ে রবে শুধু।
প্রায়াণ নিজের ঠোঁট জোড়া নিশুতির কপালে খুবই আস্তে,ধীরে....ছোঁয়ায়। নিশুতি ঈষৎ কেঁপে উঠে। তারপর নিশুতির ডান ব্রু'য়ের উপর,এরপর বাম ব্রু...তারপর ডানচোখের উপর,এরপর বাম চোখে...একটু নিচের ডান গালে...সরু নাকটায়....তারপর বাম গালে....নিশুতির খাঁজ কাটা থুতনিতেও....প্রায়াণ একটার পর একটা চুমু এঁকে যায়। খুব আলতো ভাবে....খুব অধর ভাবে...খুব আস্তে......
নিশুতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরায় শিরায় কাপুনি জাগে। তার পুরো শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠে প্রতিটা ক্ষণে। যেন এক অদ্যম প্রতিযোগিতা শুরু করেছে দেহটা। কেপে উঠার প্রতিযোগিতা...
নিশুতির ঠোঁট বরাবর গিয়েও প্রায়াণ থামে।নিশুতির চোখজোড়া বন্ধ ছিল তখন। সে চোখ খুলে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ এক ঘোর লাগা চাহুনিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিশুতি ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
-----------কী?
-----------ঠোঁটজোড়া তুমি ছুঁয়ে দাও।
নিশুতি নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
---------আমি পারবো না।
প্রায়াণ মিনতির সুরে বলে,
---------প্লিইইইজ...
নিশুতি জবাব দেয়না। বারান্দার বাহিরে সুদূর উঁচু পাহাড় গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই বৃষ্টি নামে। আর সাথে একচোট বাতাস। নিশুতি শিউরে উঠে ঠান্ডায়। আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে প্রায়াণ কে। প্রায়াণ আবারো মিনতির সুরে বলে,
---------একবার? শুধু একটাবার....
নিশুতি প্রায়াণের দিকে মুখ তুলে তাকায়। প্রায়াণের কণ্ঠে এ কেমন মাদকতা! নিশুতির জানা নেই। সে মাদক না নিয়েও মাতাল হয়ে গেছে বোধহয়। ভন ভন করছে মাথার ভিতরে। সবকিছু ফাকা ফাকা লাগছে। প্রায়াণকে দেখাচ্ছে দুটো...
একটা জামা কাপড় পরিহিতা প্রায়াণ...আরেকটা নগ্ন!!
ইশ! কি বিদঘুটে...!!
নিশুতি কথা বলে না। কি এক ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে। প্রায়াণের চোখ স্থির। সে অপেক্ষায় আছে নিশুতির তরফ থেকে একটা, মাত্র একটা অধর স্পর্শের।
হঠাৎ....
নিশুতির দুচোখ ফেটে ঝমঝমিয়ে জল নামে।যেভাবে আকাশের বুক চিড়ে আসে বৃষ্টি.. প্রায়াণের ঘোর কাটে। সে হতচকিত হয়।
নিশুতির গাল চেঁপে ধরে বলে,
----------কাঁদছো কেনো? কি হলো তোমার?? নিশুউউউ....
----------হিসসসসস....
নিশুতি আঙুল দিয়ে প্রায়াণের কথা বলা আটকায়। একটা সদ্য জন্মানো কবুতরের বাচ্চার মতো প্রায়াণের বুকের মাঝে ঢুকে যায়। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,
--------এতো সুখ!! এতো সুখ কেনো চারিদিকে?? আচ্ছা...এতো সুখ আমার কপালে সইবে তো? সইবে তো? সইবে তো??
নিশুতি পাগলের মতো এককথায় বারবার আওড়াতে থাকে। প্রায়াণ স্মিত হেসে নিশুতির মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে তার বুকের ভেতর।
বলে,
---------কেনো সইবে না? তুমি চাইলেই সইবে। অবশ্যই সইবে।
নিশুতি পাল্টা জবাব দেয় না। প্রায়াণের বুকের সাথে মিশে থাকে। যেন এক বিড়ালছানা সে। আহা,প্রায়াণের গা থেকে এক অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ বের হচ্ছে। নিশুতি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেলো নাকি!
তারপর...
তারপর নিশুতির মাথা তুলে তার। প্রায়াণ নিশুতির দিকে তাকায়। তার চোখে প্রশ্ন,"কি?"
নিশুতি সে প্রশ্নের জবাব দেয়না। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। এরপর কিছু শ্বাসরুদ্ধকর মুহুর্ত..
নিশুতি নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে নিজের সর্বশক্তিতে চেঁপে ধরে প্রায়াণের ঠোঁট। প্রায়াণ চমকায়। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়।
এদিকে যে দু কাপ কফি জুরিয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলো,তা থেকে যে আর ধোঁয়া বের হচ্ছে না,দূর পাহাড়ের গায়ে যে রুমঝুম বৃষ্টি আছড়ে আছড়ে পড়ছে,তা আর ওদের দেখা হয় না।
.
.
.
শারমিন হোসেন রুমের ভেতর অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন। কিন্তু মনে তার এক অদ্ভুত শান্তি। তার সামনেই বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আজহার হোসেন পত্রিকা পড়ছেন। পত্রিকাতে লেখা, হবিগঞ্জে এক পিতা তার দ্বিতীয় বউয়ের কথামতো তার প্রথম পক্ষের একমাত্র মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আজহার হোসেন আফসোস করে উঠেন। বিরবির করে বলেন,
-------আহা আহা! দুনিয়াটা একদম গেলো শেষ হয়ে। কেয়ামত আসার আর বাকি নাই।
অথচ তিনিই যে নিশুতিকে পিটিয়ে না মেরে মানসিক ভাবে দিনে দিনে মেরে ফেলেছে,সে হিসেব কে করবে?
শারমিন হোসেন গর্জে উঠেন।
------রাখবে তোমার পত্রিকা?? আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছি।আর উনি আছে উনার খবর নিয়ে!!
আজহার হোসেন তবুও পত্রিকা রাখেন না। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন,
--------কিসের চিন্তা??
শারমিন হোসেন ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে আজহার হোসেন এর পাশে এসে বসেন।
---------তোমার ভাই যদি নিশুতিকে না পেয়ে আমাদের নামে মার্ডার কেস করে! যে আমরা নিশুতিকে মেরে গায়েব করে ফেলেছি তখন??
আজহার হোসেন ভ্রু কুঁচকে স্ত্রীর দিকে তাকান। এসব সিনেমা নাটক সিরিয়াল দেখতে দেখতে সবকিছুতেই একদম ফিল্মি হয়ে গেছে মহিলাটা। আজহার হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শারমিন হোসেন তা দেখেন না। সে আর্তনাদ করে উঠে,
--------আমি কিন্তু বাপু আমার বাপের জনমেও জেল কাটিনি। এবার যদি কাটতে হয়না,তবে তোমার ঐ মেয়েকে আমি সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবো বলে দিলাম।।আজ না হোক কাল,তাকে সামনে পাবো তো নাকি??
শারমিন হোসেন গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে যান। রান্নাঘরে গিয়েই আবার বিরবির করে বলেন,
--------আর যেন সামনে না পড়ে ঐ কালনাগিনী। যেখানে গেছে যাক,বিদেয় যে হয়েছে এই বেশ।
.
.
প্রায়াণ নিচে গেছে। কি নাকি আনতে হবে তার। নিশুতি একা একা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার। এখনি যাওয়া দরকার ছিল!! কি এমন দরকারি জিনিস!!
ধ্যাৎ!
হঠাৎ নিশুতির ফোন বেজে উঠে। ডিভানের উপর দিয়ে ফোন নিয়ে দেখে ইফতির ফোন।
--------হ্যালো ভাই।
---------কেমন আছিস?
---------এইতো। তুই?
---------ভালো আছি।
----------ওদিকে সব কি অবস্থা?
----------সব শান্ত। তুই পালিয়ে গিয়ে আম্মু আব্বুকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস বোধহয়!
নিশুতি শুকনো হাসে কথাটা শুনে।
ইফতি বলে,
--------কি করিস?
--------বসে আছি।
---------প্রায়াণ ভাই কই?
---------নিচে গেছে কি জানি আনতে!
---------ওহ।
দু ভাই বোনের টুকটাক আলাপ চলে। ফোন রেখে দিয়ে নিশুতি ভাবে ভুল করে ফেলেছে সে। ইফতিকে একবার বলে উচিত ছিল যে প্রায়াণ নামক লোকটা তার পুরোটা মন দখল করে নিয়েছে...
.
.
পার্সেলটা হাতে নিয়ে প্রায়াণ রওনা হয় রিসোর্টের দিকে। মুখে তার শান্তির হাসি। মনে মনে ভাবে,নিশু পাগলি টা তার সারপ্রাইজ দেখে অনেক খুশি হবে...অনেএএএক..
চলবে......

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)