রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ২৫)


কাঁচের বাহিরে একটা পেলব দুপুর। ব্যস্ত শহর টাকে আরো ব্যস্ত করে তুলছে যেনো। শান একটা রেস্টুরেন্টের দোতালায় বসে সেই ব্যস্ত শহর দেখতে ভীষণ ব্যস্ত। সূয্যিমামা উঠার আগেই এসব মানুষের দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। কিসের এতো কাজ তাদের! শান বুঝতে পারেনা।
"এই যে মিস্টার..."
শান চমকে তাকায়। ঘোর কেটে দায়সারাভাবে বলে,
"আরে মিস নম্রতা। আসুন আসুন। বসুন না...!"
শান উঠে চেয়ার ঠেলে তাকে বসার আমন্ত্রণ জানায়। ধীরভাবে বসতে বসতে নম্রতা বলে,
"আমি কি খুব দেড়ি করে ফেললাম!"
শান হেসে মাথা নাড়ায়।
" না না। আমিই বোধহয় দ্রুত চলে এসেছি।"
নম্রতা উত্তরে হাসি ছুড়ে দেয়। শান একটু ওয়েটার কে ডেকে নম্রতার দিকে তাকায়।
"কি খাবেন?"
নম্রতা কিছুক্ষণ মেনু কার্ডের দিকে চোখ বুলায়। তারপর বলে,
"একটা স্ট্রং কফি। আর কিছু না।"
ওয়েটার তার কার্ডে অর্ডার লিখে শানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
"স্যার আপনি?"
"একটা ব্ল্যাক কফি।"
"ওকে স্যার।"
ওয়েটার বয় চলে যায়। আর শান পুরোপুরি ভাবে তাকায় নম্রতার দিকে। এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সে আর নম্রতা কফিশপে এসেছে। প্রথম বার শানই অফার করেছিল নম্রতাকে। নম্রতাও তার এই নতুন বন্ধুকে না করেনি। কিন্তু এবার ডেকেছে স্বয়ং নম্রতা।
নিরবতা ভেঙে শান বললো,
"ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার জন্য ডেকেছো। এখন চুপ কেনো। বলো কি বলবে।"
নম্রতা প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথাটা বলার জন্য মোটামুটি একটা প্রিপারেশন নেয়৷ তারপর ক্ষীণ গলায় বললো,
"আমি একটা মিথ্যা বলেছি এতদিন তোমাকে।"
শানের কপাল নিজ থেকেই কুঁচকে যায়।
সে বিষ্মিত গলায় বলে,
"কি মিথ্যে কথা?"
"আমি তোমাকে বলেছিলাম আমি প্রায়াণের জীবন থেকে সরে এসেছি।"
"হুম তো?"
"আসলে আমি সরে আসিনি শান। আমি এখনো ওর জীবনে আছি। আর ওর জীবনেই থাকতে চাই বিধায় আমি আর আন্টি মানে প্রায়াণের আম্মু..."
শান একটু বিধ্বস্ত হয় কথাটা শোনার পর। সে ভেবেছিল একটা সঠিক সময় এলে নম্রতাকে নিজের ভালোবাসার কথা বলবে কিন্তু...!
শান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
"কি করেছো তোমরা?"
"আমি কিছুই করিনি।আন্টিই করেছে যা করার। ভদ্র শাশুড়ি সেজে প্রায়াণ আর স্ত্রী কে দূরে দূরে রেখেছে এতদিন। এবং আই থিংক ওরা ওদের দাম্পত্য জীবনও শুরু করতে পারেনি এখনো।"
নম্রতার চোখ চকচক করে উঠে। সে বলে চলে,
"শুনলাম কাল রাতে নাকি দুজনে ঝগড়া করে আলাদা রুমেও ছিলো। আমার কি মনে হয় জানো শান? খুব বেশিদিন টিকবে না এই সম্পর্ক। যেভাবে হুট করে হয়েছিল,সেভাবে হুট করেই ভেঙে যাবে। আর তখন....তখন প্রায়াণ শুধুই আমার। আর আমি শুধুই প্রায়াণের।"
নম্রতার ঐ চকচক করতে থাকা চোখে শান একধরনের পৈচাশিকতা দেখতে পায়। শানের ভেতর টা হঠাৎই প্রচন্ড ঘৃণায় তলিয়ে যায়। সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে এখন,সুন্দর চেহারার অধিকারী রা সবসময় সুন্দর মনের অধিকারী হয়না।
শান কে নিম্নমুখী হয়ে বসে থাকতে দেখে নম্রতা প্রশ্ন করে,
"কি ব্যাপার কিছু বলছো না যে!"
শান মুখ তুলে তাকায়। থমথমে মুখ করে বলে,
"তুমি না একটা মেয়ে নম্রতা? এক তরফা ভালোবাসায় এতটাই পাগল হয়ে গেছো যে ভালো মন্দ কিছুই বুঝে আসছে না তোমার? প্রায়াণ যেখানে তোমাকে ভালোইবাসে না,সেখানে তুমি ওকে কেনো জোর করে নিজের করতে চাচ্ছো? জোর করে কি ভালোবাসা হয় নম্রতা??"
নম্রতা চুপ।
শান বললো,
"আজকে যখন তুমি আমাকে একটা সত্যি বললেই তখন আমিও একটা সত্যি বলি। প্রথম যখন তোমাকে দেখেছিলাম,তখন থেকেই তোমার জন্য একটা ভালোলাগা কাজ করতো আমার। এরপর তোমার সাথে মিশতে গিয়ে,চলাফেরা করতে গিয়ে,কথা বলে, ধীরে ধীরে তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম। ইয়েস আই লাভ ইউ নম্রতা।"
নম্রতা চমকে তাকায়। শান একটুও বিচলিত হয় না। বলে,
"কিন্তু কই? আমি কি তোমাকে জোর করে পেতে চাচ্ছি? আমার ভালোবাসাও তো একতরফা। এখন আমারও উচিত না তোমার মতো তোমাকে জোর করে পাওয়ার?? তাই নয় কি নম্রতা?"
নম্রতা ক্রুর দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকায়। শান হেসে বলে,
"কিন্তু আমি তো তোমাকে জোর করে পেতে চাইনা। কারন আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয়না নম্রতা। তাই তোমাকেও একটা কথাই সাজেস্ট করবো,শুধু শুধু অন্যের সুখের সংসার নষ্ট করো না।"
নম্রতা ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কঠিন গলায় বলে,
"আমি কি করবো না করবো তা আমার ব্যাপার। একটা ভালো ফ্রেন্ড ভেবেছিলাম তোমাকে। অন্য কিছুই না আর কিছু হবেও না। আজকের পর থেকে আমার সাথে কন্টেক্ট করারও চেষ্টা করবে না তুমি। বায় ফরেভার।"
হনহন করে নম্রতা চলে যায়। নম্রতা চলে যেতেই শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। ওয়েটার বয় দুটো কফি নিয়ে আসে তখনি। অনুনয়ের সুরে বলে,
"সরি স্যার। আমাদের ম্যানেজমেন্ট এ একটা সমস্যার কারনে দেড়ি হয়ে গেলো। এক্সট্রিমলি সরি।"
শান আলগা হেসে পকেট থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট বের করে। ওয়েটারের হাতে দিয়ে বলে,
"কফির আর প্রয়োজন নেই।"
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা চা খাচ্ছিল নিশুতি। প্রায়াণ এসে তার পাশে দাঁড়ায়।
"এখনো রাগ আমার উপর? "
নিশুতি কিছু না বলে মাথা নাড়ে শুধু। প্রায়াণ দু'হাতে তাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
"সরি রাঙাপরী। কালকে রাতে মাথা ঠিক ছিল না। কেনো যে ওমন রিয়েক্ট করেছিলাম তোমার উপর নিজেও জানিনা। সরি জান। আর হবে না।"
নিশুতি প্রায়াণের মাথায় ছোট করে গাট্টা মেরে বললো,
"ইটস ওকে। আমি বুঝেছি। কিন্তু তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে খোলাখুলি ভাবে কথা বলতে চাই প্রায়াণ।"
প্রায়াণ মুখে একটা সিরিয়াস ভাব এনে বললো,
" হুম বলো।"
নিশুতি চায়ের কাপ টা গ্রিলের উপর রাখে। নিচু স্বরে বলে,
"আমার কেনো যেনো খালি মনে হয় তোমার আম্মু ইচ্ছে করে আমাকে আর তোমাকে দূরে দূরে রাখে প্রায়াণ। আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হোক তা উনি চায় না। উনি বোধহয় এখনো চায়,নম্রতাই তোমার বউ হোক। এমন কেনো মনে হচ্ছে আমার প্রায়াণ?"
প্রায়াণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
"কারন তোমার এই ভাবনা গুলো ঠিক। তাই। আমারও এই ভাবনাই মনে আসে খালি। মা আসলেই একটু বেশি বেশি করতেছে।"
"কি হবে প্রায়াণ? এভাবে চললে তো একটা সময় আমাদের আলাদা...".
নিশুতি কথা শেষ করার আগেই প্রায়াণ তার মুখ চেপে ধরে।
ধমকে বলে,
" আউল ফাউল কথা বলবা না। আর তুমি চিন্তা করো না।আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করবোই করবো।"
নিশুতি প্রায়াণের বুকে মাথা রাখে। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
"আমার খুব ভয় হচ্ছে।"
প্রায়াণ নিশুতির মাথায় হাত রাখে। শান্ত গলায় বললো,
"চিন্তা করো না। আমি কিছু একটা করবো খুব দ্রুতই।"
.
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)