রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১০)


জালাল শেখের চিল্লাফাল্লা তে মিনু শেখ হাত মুছতে মুছতে বেডরুমে আসেন।
-------কি সমস্যা তোমার? কি হইছে? চিল্লাও ক্যান??
-------তোমার আদরের ছোট ছেলে কই? দুই রাত বাসায় নেই সে!! আমি সারাদিন বাহিরে থাকি থেকে খেয়াল করতে পারিনা। আজ পিউ না বললে তো জানতামই না।
মিনু শেখ গরম চোখে পিউর দিকে তাকান। পিউ কাচুমাচু হয়ে বলে,
--------আব্বুই বলছিল প্রায়াণ ভাইকে ডাকতে। তখন আমি বলে দিয়েছি তার বাসায় না আসার কথা।
মিনু শেখ দাঁতে দাঁত ঘষেন। পারলে পিউকে চিবিয়ে খান এখনি! উটকো ঝামেলায় ফেলে দেয় মেয়েটা খালি।
মিনু শেখ বেশ শান্ত গলাতেই বলেন,
-------প্রায়াণ বরিশাল গেছে। ওর স্পোর্টস টিম এর সাথে। কি নাকি খেলা আছে শুনলাম!
-------কই এই ব্যাপারে তো আমাদের কিছু বললো না।
-------আমাকে তো বলে গেছে নাকি?? এত চিল্লাচ্ছো কেন তাহলে? বাচ্চা না ও।
জালাল শেখ রাগে গজগজ করতে করতে বিছানার উপর বসে টিভি ছাড়েন। মায়ের জন্য ছেলেদের ব্যাপারে কিছু বলাই যায় না!! এহ! আহ্লাদ!
প্রেমা দরজার দোরে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে পায়৷ তার মন বলছে প্রায়াণ ভাই বরিশাল নেই। সে অন্য কোথাও আছে। কিন্তু কোথায়!?
.
.
ফোনের শব্দে নিশুতির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই সে তার জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা টা খায়। প্রায়াণ তাকে ঝাপ্টে ধরে ঘুমোচ্ছে!!!
নিশুতি চিবুকের উপর হাত,নিশুতির গায়ের উপর এক পা আর প্রায়াণের মাথা টা মিশুতির গলার কাছাকাছি..!!
ছিঃ!
নিশুতির গা গুলিয়ে উঠে। থরথর করে কাপতে থাকে সে। আচ্ছা গভীর কিছু হয়ে যায়নি তো..!
নিশুতির ফোনের রিং পড়ে কেটে যায়। আবার রিং বেজে উঠে৷ ফোন টা ধরা উচিত। নিশুতি নড়ে উঠে। প্রায়াণ তাকে যেভাবে লেপ্টে রেখেছে নিজের সাথে এতে তার সাধ্য নেই উঠার।
নিশুতি রিনরিনে কণ্ঠে প্রায়াণ কে ডাকে,
--------এই যে শুনছেন....!
নিশুতি নড়াচড়া বাড়িয়ে দেয়। প্রায়াণের ঘুম ছুটে যায়। পিটপিট করে চোখ মেলতেই সে নিজেকে নিশুতির এত কাছাকাছি আবিষ্কার করে। প্রায়াণ লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। নিশুতিও উঠে গায়ের ওড়না সামলায়। প্রায়াণের দিকে তাকাতে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে সে। তারপর এক দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়।
----------হ্যালো ইফতি।
ইফতি ওপাশ থেকে রাগ চাপানো গলায় বলে,
----------তুই আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস বোন??
নিশুতি হকচকিয়ে যায়। এমন প্রশ্ন কেন করলো ইফতি! সে কি প্রায়াণের ব্যাপারে জেনে গেছে সব?? এখন কি তারও উচিত ইফতিকে সবটা বলে দেওয়া??
---------কি হলো কথা বলছিস না কেনো??
ইফতির ধমকে নিশুতি বাস্তবে ফিরে। নিজেও গলায় হালকা রাগ এনে বলে,
----------আমি তোর থেকে বড় ইফতি!!
ইফতি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
----------সরি।
----------হুম।
অনেকটা শান্ত গলায় বলে,
---------আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস আপু??
নিশুতি অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
---------কেন বলতো?
ইফতি কথা না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলে,
---------কালকে রাতে আমি তোকে কল দিয়েছিলাম। একটা ছেলে ধরেছিল। ছেলেটা কে? কে আছে তোর সাথে??
নিশুতি নির্বাক হয়ে পড়ে। ইফতি যদি নিশুতিকে ভুল বুঝে!!
নিশুতি চাপা গলায় বললো,
---------বলবো কিন্তু আগে প্রমিস কর যে তুই আমাকে একদম ভুল বুঝবি না।
ওপাশ থেকে ইফতি বলে,
---------আচ্ছা বল।
নিশুতি একটা লম্বা দম ফেলে বলতে শুরু করে,
---------সেদিন রাতে যখন আমি পালাচ্ছিলাম,প্রায়াণ ভাইয়ার সামনে পরে যাই। সে আমার থেকে সবটা শুনে। আর আমি যে পালাচ্ছি সেটাও...এরপর ভাইয়া আমাকে একা কিছুতেই ছাড়তে রাজী হচ্ছিল না। বলছিল তুমি একা একটা মেয়ে,সিলেট যাবা। অচেনা অজানা জায়গা। যদি কোনো বিপদ ঘটে। তাই....
ইফতি আগ্রহী সুরে বলে,
-----------তাই??
-----------তাই প্রায়াণ ভাইয়া আমার সাথে আসছে। বর্তমানে সে আমার সাথেই আছে। আর যতদিন আমি পালিয়ে থাকবো ততদিন সেও আমার সাথে সাথে থাকবে। এটাও বলছে।
ইফতির মাথায় বাজ পড়ে যেন!! যার জন্য এত কিছু সেই কিনা এখনো নিশুতির সাথে...!!!
ইফতি অনেকটা চেঁচিয়ে বললো,
--------মাথার তার মার সব ঠিক আছে তো তোর? নাকি ছিড়ে গেছে?? তুই জানিস না তাকে নিয়েই এত সমস্যা হলো আর সেই তাকে নিয়েই তুই কীনা!! জানাজানি হয়ে গেলে কি হবে ভাবছিস একবারো?
নিশুতি চুপ করে থাকে।
ইফতিও চুপ । সে কি বলে নিশুতিকে বকবে বুঝতে পারছে না।
নিশুতি দুর্বল গলায় বলে
-------আমি নিজেও জানিনা আমি কেন তার সাথে আসছি। হয়তো একা একা সাহস হচ্ছিল না তাই...!
ইফতি রাগী গলায় বলে,
--------সাহস না হলে আমাদের বলতি। আমি অন্য কোনো ব্যবস্থা করতাম কাকার সাথে কথা বলে। তাই বলে.....! নিশুতি তুই কত বড় একটা ভুল করছিস।বুঝতেছিস??
--------শোন বেশি চিল্লাবি না। এত ঝামেলা আমার সহ্য হয়না!! আমি উনাকে দুদিন বাদে পাঠিয়ে দিবো বুঝিয়ে সুজিয়ে। কেউ জানবে না কিছু৷ তুই ও কাউকে কিছু বলবি না। কাকাকেও না।
ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
--------তোর যেটা ভালো লাগে তুই সেটাই কর। আমি এই বিষয়ে কিছু জানিনা। রাখছি।
ইফতি ফোনের লাইন কেটে দেয়৷ নিশুতির বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এত কষ্ট! এত যন্ত্রণা...!
 এরকম জীবন কেন হয় মানুষের..!
নিশুতিকে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রায়াণ তার পিছে গিয়ে দাঁড়ায়।
নরম গলায় বলে,
-------নিশু।
সেই ডাকে এত আবেগ...এত টান...
নিশুতি মুহুর্তেই সমস্ত কষ্ট ভুলে শিউরে উঠে। ধরা গলায় বলে,
-------হু।
--------আমার দিকে ফিরো। কি হয়েছে তোমার?? আসলে রাতে তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলা। পরে আমি তোমার মাথার কাছেই বসেছিলাম সারাক্ষণ। কখন যে ওভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি নিজেও জানিনা।
প্রায়াণ মাথা নিচু করে বলে,
--------আ'ম সরি।
নিশুতি প্রায়াণের দিকে ফিরে তাকায় না। সে চায় না তার চোখে জমা নোনা পানি প্রায়াণ দেখুক। বারান্দার গ্রিল দিয়ে বাহির পানে মুখ করেই বলে,
-------ইটস ওকে। আমি জানি আপনি কিছু করেন নি ইচ্ছাকৃতভাবে৷ জানেন,আমি আমার জীবনে শুধু বিশ্বাস করেছিলাম আমার আম্মু কে৷ সে আমার বিশ্বাস এর মর্যাদা সবসময় রাখছে। দ্বিতীয় বিশ্বাস করি আপনাকে। আপনিও আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন আশা করি।
প্রায়াণ কিছুটা স্বস্তি পায়। নিশুতি তাকে ভুল বুঝেনি এই তো ঢের!
প্রায়াণ হালকা কেশে স্নিগ্ধ গলায় বলে,
-------আই উইল নেভার ব্রেক ইউর ট্রাস্ট। আই প্রমিস।
নিশুতি ছোট্ট করে জবাব দেয়,
-------হুম।
তারপর দুজনেই চুপচাপ। নিশুতি বাহির দেখছে আর প্রায়াণ নিশুতির পেছনের দিকটা৷ মেয়েটার ঘাড়ে একটা ছোট কালো তিল আছে। ঈশ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে...!
প্রায়াণের ঘোর কাটে কারো চাপা কান্নার শব্দে। নিশুতি থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। নিশুতি কি কাঁদছে...?
প্রায়াণ এর হৃদযন্ত্র টা ধক করে উঠে। সে একটানে নিশুতিকে নিজের দিকে ঘোরায় এবং প্রায় আচমকাই নিশুতি প্রায়াণ কে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠে। প্রায়াণ ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল।
নিশুতি প্রায়াণের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদছে। প্রায়াণ কোনো প্রশ্ন করে না৷ হয়তো মেয়েটার মনের গভীরে কোনো ক্ষত আবার মাথা নেড়ে উঠেছে! কাদুক না মেয়েটা। কেঁদে যদি শান্তি পায়,নিজেকে হালকা মনে করে তবে তাই বেশ...
প্রায়াণ আলগোছে নিশুতিকে জরিয়ে ধরে।
অনেকক্ষণ কাঁদে নিশুতি।
অ....নে.....ক.... ক্ষ....ন
তারপর নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় প্রায়াণের বুক থেকে। প্রায়াণ ও ছেড়ে দেয় নিশুতিকে।
নিশুতি চোখ মুছে ভেতরের ঘরে পা বাড়ায়। আজ তার ভীষণ মনে পড়ছে নিজের মাকে... কেন কে জানে!
.
.
প্রায় প্রতিদিনই একটা মেয়ে নদীর পাড়ে এসে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রকৃতি অনুভব করে নাকি কোনো কিছু নিয়ে ভাবে শান তা জানে না।
তবে আজ মেয়েটা একটু বেশিই অন্যমনস্ক। চোখের নিচে হালকা কালির আভাস, মুখটা বিবর্ণ।
শান ধিমি পায়ে মেয়েটার দিকে আগায়। মেয়েটার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
--------আজকে প্রকৃতি একটু বেশিই উদাসীন। তাইনা??
মেয়েটা প্রথমে জবাব দেয় না। খানিক পরে জবাব দেয়,
-------হয়তো!
শান এতদিন পুরোপুরি মেয়েটাকে দেখতে পারেনি। দূর থেকেই দেখে এসেছে। আজ একদম কাছাকাছি থেকে দেখতে পেয়ে তার চোখজোড়া থমকে যায়। কী ভীষণ মিষ্টি মায়াবী মুখ খানা!!
শান মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
-------আ'ম শান চৌধুরী। এন্ড ইউ?
মেয়েটা হাত বাড়ায় না। উদাসী ভাবেই বলে,
------আমি নম্রতা৷ মিস নুসাইবা নম্রতা।
শান হাত সরিয়ে নেয় দ্রুতই। আননোন একটা মানুষের সাথে কেনই বা হাত মেলাবে একটা মেয়ে!! শান নিজেই নিজেকে গালি দেয়। বেকুব গাধা কোথাকার!!
শান একটু দূরে সরে দাঁড়ায় মেয়েটার থেকে। মেয়েটার চোখে ক্লান্ত,মুখে রিক্ততা। কি হয়েছে মেয়েটার..!
---------আপনাকে প্রায় প্রতিদিন এখানে আসতে দেখি মিস!
---------হুম আসি। অফিস শেষ করে এখানেই আসি। ভালো লাগে। চুপচাপ ঠান্ডা প্রকৃতি!
শান মাথা ঝাকায়।
--------হুম। তাই তো আমিও আসি। শহরের ব্যস্ত জীবনে এরকম ঠান্ডা প্রকৃতি মনে রিফ্রেশমেন্ট এনে দেয় একচুয়ালি।
নম্রতা মাথা কাত করে সম্মতি জানায় শান'য়ের কথার সাথে।
শান চুপ।
নম্রতাও চুপ।
নিরবতা ভাঙে শান ই..
-------আজকে অন্যদিনের থেকে একটু বেশিই উদাসী আপনি। জানতে পারি কেনো?
নম্রতার কেন জানি হুট করে শান কে খুব আপন মনে হয়। তার মনে জমে যাওয়া পাথর গলানো যে খুব দরকার। নয়তো... একজীবনে বেঁচে থাকাই যে বৃথা!
নম্রতা নদীর ছলছল স্রোতের দিকে তাকিয়ে বলে,
---------একজন কে ভীষণ ভালোবাসি। তার সাথে আমার বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু সে,আমাকে হয়তো ভালোই বাসে না!!
শান কপাল কুঁচকায়। এত সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়েকে কোন গাধা ভালো না বেসে থাকতে পারে!!
শান ফট করে বলে,
-------কে সেই গবেট যে এত মিষ্টি কাউকে ভালোবাসে না??
নম্রতা মৃদু হাসে শানের কথা শুনে। শান সেই হাসির দিকেও অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে তো জানতো এরকম হাসি শুধু উপন্যাসের নায়িকাদের হয়। বাস্তবেও হয়! শান আজ না দেখলে সত্যিই জানতো না।
নম্রতা মৃদু হাসি মুখেই বলে,
--------গবেট টার নাম প্রায়াণ। একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট আমরা।
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)