রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ২১)


নিশুতি লজ্জায় প্রেমার হাতে জোরে টিপ্পনী কাটে। প্রেমা বুঝতে পেরে পিউকে বললো,
"অনেক বড় হয়ে গেছিস না?? চল। বাহিরে চল"
একপ্রকার বগলদাবা করে প্রেমা পিউকে নিয়ে বাহিরে যায়। প্রায়াণ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
"আজকালকার ছেলেমেয়ে সো এডভান্স!!"
"হুম।কিছু বলতে চাইছিলা আমায়?"
"হ্যাঁ বলতে চাই।"
প্রায়াণ কিছুটা সিরিয়াস মুডে নিশুতির দিকে তাকায়। তারপর বলে,
"দেখো যেভাবেই হোক না কেনো,এই পরিবারের বউ এখন তুমি। আমার বাবা আমাদের মেনে নিলেও মন থেকে মেনে নেয়নি সেটা আমি বুঝতে পারতেছি আর আম্মু তো মেনেই নিলো না। তোমার এখন প্রথম এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমার বাবা মায়ের মন জয় করা। বাবার মন জয় করতে বেশি কিছু করতে হবে না। সে নম্র ভদ্র টাইপের মেয়ে পছন্দ করে। আর সেটা তোমার ভেতরেই আছে। তবে মায়ের মন জোগাতে অনেক কষ্ট করতে হবে। কিন্তু সেটা তোমাকে করতে হবে নিশুতি।"
প্রায়াণ এগিয়ে গিয়ে নিশুতির হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
"আমার জন্য হলেও করতে হবে।"
নিশুতি স্মিত হেসে বলে,
"তুমি চিন্তা করোনা। আমি জানিনা আমি পারবো কীনা কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?"
প্রায়াণ নিশুতির কথায় সন্তুষ্ট হয়। নিশুতিকে নিজের বুকের মাঝে চেঁপে ধরে বলে,
"আমি জানি তুমি পারবে। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার কপালে সুখ লিখে রেখেছে।"
.
.
সামনে প্রশস্ত নদী....ধীরে ধীরে বায়ুর প্রবাহে বয়ে চলছে। কখনো বা জোরে, কখনো বা আস্তে...ঠিক যেন নম্রতার চোখের ধারার মতোন করে। কখনো ঝুপঝুপ করে ঝরছে কখনো বা ধীর ভাবে...কিন্তু ঝরছেই..
নম্রতার থেকে কিছুটা দূরে শান দাঁড়িয়ে। নম্রতাই ডেকে এনেছে তাকে। শান অফিসের কাজ বাদ দিয়ে সোজা চলে এসেছে নম্রতার ডাকে। কিন্তু আসার পর থেকে একটা কথাও বলছে না সে। শুধু চোখের পানি ফেলছে। এদিকে শানের যে বুকের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে তা কি নম্রতা বুঝবে!
শান একটু এগিয়ে নম্রতার পাশাপাশি দাঁড়ায়। হালকা গলায় বললো,
"কি হয়েছে? এভাবে ডেকে এনে কাঁদছেন কেনো?কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন।"
নম্রতা যেন একটা শক্ত কাধ খুঁজে পেলো। শানের কাধ। সে শানের দিকে পুরোপুরি হেলে তার কাধে মাথা রাখে। অশ্রুসিক্ত চোখেই জবাব দেয়,
"আমার ভালোবাসা তার ভালোবাসা কে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। সে আজ থেকে বিবাহিত।"
শান ঠিকভাবে বোঝে না কথাটা। সে একটু চুপ থেকে বলে,
"বুঝলাম না কিছুই"
নম্রতা এবার শানের কাধ থেকে মাথা সরিয়ে সরু চোখে শানের দিকে তাকায়। সেই অশ্রুসিক্ত চোখ যেন শানের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বাড়িয়ে তিনগুণ করে দিলো। শান ভয় পায়। এতো জোরে হার্টবিট করছে!! যদি শুনে ফেলে নম্রতা তা...!
নম্রতা দায়সারাভাবে আবার বলে,
"প্রায়াণ আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। সে যাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।"
শান এবার বুঝতে পারে।
ছোট্ট করে জবাব দেয়,"ওহ"
"আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এমন কিছু হবে জানেন! আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কাকে দেখাবো এই ফাটা বুকের কষ্ট"
শান চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। সত্যি বলতে তার মনে একটা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেনো যেনো সে নম্রতা নামের এই মিষ্টি মেয়েটাকে হারাতে চায়না।
নম্রতা আবারো বলে,
"স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি জীবনে কোনো বন্ধু করিনি আমি। একমাত্র প্রায়াণের জন্য। ওই আমার সব ছিল। আর ওই আমাকে এভাবে ঠকালো!"
শান নম্রতার কাধে হাত রেখে বলে,
"প্রায়াণ কি আপনাকে কখনো ভালোবেসে ছিল?"
নম্রতা ছোট করে বলে,
"উঁহু।"
"তাহলে অযথা ওকে দোষ দিচ্ছেন। সে তো আপনাকে ভালোবাসেনি,স্বপ্নও দেখাইনি। যদি আপনার সাথে রিলেশন করে অন্য কাউকে বিয়ে করে আনতো তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি ঠকতেন। কিন্তু সে তো এসব কিছুই করেনি। আপনাকে সে ঠকাই নি,বরং আপনি আপনার এক তরফা ভালোবাসায় ঠকেছেন। এটাকে মানতে হবে আপনার।বাস্তবতা বড়ই কঠিন মিস নম্রতা।"
নম্রতা চুপ করে থাকে। শানের প্রতিটি কথাই সত্য। সে এর জবাব খুঁজে পায়না। একবার ভাবে,সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে তার বাবার কাছে। আবার মনের কিনারায় কোথাও একটা ভরসা খুঁজে পায় মিনু শেখ এর কথায়। সে তো কথা দিয়েছে তাকে..
নম্রতা সাতপাঁচ ভেবে চোখ মুছে মুখে হাসির রেখা টানে। বলে,
"চটপটি খান? আমার সাথে খাবেন আজ?"
শান মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করে। এই মেয়েটাকে হাসলেই ভালো লাগে...কাঁদলে একদমই না...
.
.
প্রেমা দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে একা হাতে। তা দেখে নিশুতি এগিয়ে আসে।
"আন্টি কোথায়?"
প্রেমা সরু চোখে,কপাল কুঁচকে বলে,
"কে আন্টি?"
"আরে তোর আম্মু!"
"আমার আম্মু তোর আন্টি?"
নিশুতি জিভ কাটে। বলে,
"হুট করে মা বলাটা কেমন না!"
"কেমন হলেও তোকে বলতে তো হবেই।"
"হুম। অভ্যাস হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। এখন বল সে কই? তুই একা সব করছিস কেনো?"
"আম্মু ভীষণ রাগ রে। সে কি এখন এসব রান্না বান্নার আয়োজন করবে? তোর মনে হয়? তাই আমিই..."
"আমিও হেল্প করি তোকে?"
"না তুই যা। আমি পারবো।"
"আমি করবো বলছি না..!"
নিশুতি জিদ করে। প্রেমা তার জিদের কাছে হেরে যায়। কাটা মাংস গুলো নিশুতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
"এগুলো রান্না হবে আজ। তুই পারবি করতে?"
নিশুতি গর্ব করে বললো,
"সে আর বলতে! আমিই পারবো। দে আমায়।"
নিশুতি খুব যত্ন সহকারে মাংসের পিস গুলো ধুয়ে নেয়। তারপর মশলা হলুদ মরিচ লবন মাখিয়ে ভাজতে শুরু করে। প্রেমা দেখে বলে,
"একাই পারবি মনে হচ্ছে! তাহলে তুই রান্না কর। আমি আসতেছি।"
প্রেমা বাহিরে আসতেই দেখে প্রায়াণ দাঁড়িয়ে। সে রান্নাঘরেই ঢুকতে নিচ্ছিলো। প্রেমাকে দেখে বলে,
"তোর ভাবী ভেতরে?"
প্রেমা মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
"হ্যাঁ রান্না করছে। এত চোখে হারাও কেনো ওকে??"
প্রায়াণ মৃদু হাসে। উত্তর দেয়না। প্রেমা বলে,
"ভাইয়া তোমার সাথে আমার কথা আছে। চলো বারান্দায় যাই?"
"চল।"
দু ভাইবোন মিলে বারান্দায় এসে বসে। প্রেমা প্রশ্ন করে,
"তোরা ধরা পড়লি কি করে ওদের হাতে?"
"কাদের হাতে?"
"যারা তোদের বিয়ে পড়িয়ে দিলো তাদের হাতে।"
প্রায়াণ প্রশ্ন বুঝতে পেরে বলে,
"আমরা তাবু টানিয়ে ছিলাম সারারাত পান্থুমাই ঝর্ণার কাছেই একটা খোলা জায়গায়। সেখান থেকেই সকালে ধরা পড়ি।"
"তারা জানলো কি করে যে তোরা বিবাহিত না?? বলতে পারলি না যে তোরা স্বামী স্ত্রী??"
প্রায়াণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
"তোর মতো ওত বুদ্ধি কি আমাদের আছে! ছাগল!!. বললেই বিশ্বাস করে নেয়?? ওরা ম্যারেজ সার্টিফিকেট চায়। সেটা না থাকলে বলে উভয়ের বাবা মাকে কল করতে। তখন? কি করতাম,আমি আম্মু আব্বুকে কল করতাম??"
প্রেমা আফসোস করে বলে,
"কত আশা ছিল তোর বিয়ে নিয়ে! অথচ কি হয়ে গেলো। যাক গে,বিয়ে ঠিকভাবে হয়নি তো কি হইছে। বাসর রাত জমিয়ে হবে। বিকেল হলেই ফুল নিয়ে আসবো। আমি নিজ হাতে সাজাবো ভাই।"
বলেই দাত কেলিয়ে হাসতে থাকে প্রেমা। প্রায়াণ চোখ পাকিয়ে বললো,
"খুব পেকেছিস না??বেয়াদব। যা এখান থেকে।"
প্রেমা মুখ বাকিয়ে চলে যায় বারান্দা থেকে। প্রায়াণ একা দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। আচ্ছা,বাসর রাতে তো স্ত্রী কে উপহার দিতে হয়। না?? প্রায়াণ ভাবতে থাকে কি উপহার দেওয়া যায় তার নিশুতিকে...
.
.
জালাল শেখ চোখ বুজে শুয়ে আছেন। ঘুমাচ্ছেন নাকি জেগে আছেন বলা যাচ্ছে না। মিনু শেখ সেসব জানতেও চান না। সে সোজা গিয়ে দুম করে বসে পড়ে তার পাশে। বিলাপ জুড়ে দেয় কানের কাছে।
"তুমি কেমনে পারলা ওদের মেনে নিতে? তোমার কারনে আমার ছেলেগুলো একদম নষ্ট হয়ে গেলো। আজ প্রায়াণ কে মেনে নিলা,তা দেখে আবার বড় ছেলেও না বিয়ে করে নিয়ে আসে এভাবে!!! আর মেয়ে দুইটা তো এখনি গেছে। ছেলে বন্ধুর অভাব নেই তাদের। কবে জানি ওরাও কিছু করে বসে!! তোমার জন্য আমার বান্ধুবীর কাছে আমার মান সম্মান কিচ্ছু থাকলো না। নম্রতার মা যখন এসব শুনবে কি জবাব দেবো আমি ওকে?? আর নম্রতাও বা কি পরিমাণে কষ্ট পাচ্ছে তুমি জানো? ক্যান করলা এমন তুমি??"
জালাল শেখ চোখ বুজেই উত্তর দেয়,
"যার বিয়ে আল্লাহ যেভাবে ঠিক করে রেখেছে তার টা সেভাবেই হবে। এটা নিয়ে এতো চিল্লাচিল্লির কি আছে!!"
"ওহ আমি ফাও কামে চিল্লাইতেছি??? প্রত্যুষের বাপ,তুমি কিন্তু বেশি বলতেছো এখন। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে বলে দিচ্ছি।"
জালাল শেখ এবার শোয়া থেকে উঠে বসেন। কঠিন গলায় বলে,
"ছেলে ভুল করছে দেখে কি ছেলেকে ফেলে দিবো? বন্যার পানি ভাইসা আইছিল ও?? মানুষই বা কি বলবে?? বরং মেনে নিয়েই ভালো করেছি।মানুষের আর বলার মুখ থাকবে না। আর আমার বাকি ছেলেমেয়েরা কি করবে কি করবে না সেটা ওরা বুঝবে।।প্রায়াণ প্রত্যুষ প্রেমা তিনজনেই ভালো বড় হয়েছে। ওরা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে শিখছে। আমি বিশ্বাস করি,যদি না প্রায়াণ ঝামেলায় পড়তো ও কখনোই এভাবে বিয়ে করতো না। আর কি যেন বললা? তোমার বান্ধুবীর মেয়ে তো আরেক ছেলের বাইকের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। আমি কি দেখিনাই? চোখ নাই আমার? আর এখন আসছে ন্যাকা কান্না করতে!! আমার তো নম্রতার থেকে নিশুতি মেয়েটাকেই বেশি ভালো লাগছে। আর প্রায়াণ নিশুতিকে পাশাপাশি মানায়ও ভালো। তুমি ফাও ফাও এতো বকতেছ!!তুমিও চোখ মেলে তাকাও একটু ওর দিকে। তুমিও বুঝতে পারবা নম্রতা কিরকম আর নিশুতি কিরকম। এবার যাও। আমি ঘুমাবো একটু। একদম প্যান প্যান করবা না কানের কাছে।"
জালাল শেখ আবার শুয়ে পড়ে। মিনু শেখ ভোতা মুখে তার পাশেই বসে থাকে। তার এখন কি করা উচিত! তার স্বামীর মতোই সব মেনে নেওয়া...নাকি টিভির ভিলেইন শ্বাশুড়ি সাজা! মিনু শেখ ভাবনায় পড়ে যান।
চলবে....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)