ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১১)
-আপা আপনারা এখানে কি করেন?
.
রকির করা প্রশ্নে পেছনে তাকিয়ে প্রিয়া বললো-
আলিনাকে খুঁজতে এসেছিলাম।
.
আলিনাকে নিজে নিজে বকবক করতে দেখে রকি বললো-
আলিনা মনি কি নতুন সাথী পাইছে?
-হু।
-কতোবড়?
-ওর সমবয়সী। আচ্ছা তুই এখন যা। চা বানা আমার জন্য।
-আচ্ছা।
.
প্রিয়ার একটা অদ্ভুত শক্তি আছে। যা হলো সে আত্মা দেখতে পায়। শুধু দেখতে পায় তা নয়, তাদের সাথে কথাও বলতে পারে। তবে সব আত্মায় সে দেখতে পায়না। যেসব মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়না সেসব মানুষের আত্মা সে দেখতে পায়।
বাড়ির বাইরে সচরাচর অনেক আত্মা দেখতে পায় সে। কিন্তু নিজের বাড়িতে আপনজন ছাড়া কারো আত্মা সে দেখতে পায়নি।
তবে ইরা কেনো তাকে দেখা দিয়েছে?
.
-আম্মু? খেলবে আমাদের সাথে?
.
আলিনার কথায় ঘোর কাটে প্রিয়ার।
মৃদু হেসে সে বললো-
নাহ। নিজের রুমে যাও আলিনা। এই রুমে আর আসবেনা।
.
ইরার হাত ধরে আলিনা এগিয়ে যেতে থাকলো নিজের রুমের দিকে।
এদিকে আলিনাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো প্রিয়া।
আলিনা ঠিক তার মতো হয়েছে।
সেও আত্মা দেখতে পায়। তবে এপর্যন্ত যতগুলো বাচ্চার আত্মা আলিনাকে দেখা দিয়েছে তারা প্রিয়াকে দেখা দেয়নি। ইরার ক্ষেত্রে তার উল্টোটা হলো কেনো?
আগে একবার তাকে দেখতে পেয়েছিলো বলে?
.
.
.
চুলোয় চায়ের জন্য পানি বসালো রকি।
হঠাৎ আলিনা এসে বললো-
আঙ্কেল আঙ্কেল? আমার জন্য দুধ বানিয়ে দিবে? কেক দিয়ে খাবো।
-দিচ্ছি।
-দুইগ্লাস দিও। আমার নতুন বন্ধুও খাবে।
-আচ্ছা মনি।
.
আলিনা ছুটে যায় নিজের রুমের দিকে।
তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো রকি।
এই বাড়িতে সব অদ্ভুত কান্ডখানা চললেও তার ভয় লাগেনা। উল্টো আফসোস হয়, কেনো সে প্রিয়া আর আলিনার মতো ভুত দেখতে পায়না!
.
.
.
নাস্তা সেরে দুপুরের খাবার তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিয়ন্তা।
ভাত রান্না করার জন্য চাল ধুতে লাগলো সে।
ইরফান রান্নাঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলো-
আমি সাহায্য করি?
.
মুচকি হেসে নিয়ন্তা বললো-
নাহ। তুমি এসে বসো এখানে একটা পিড়ি পেতে। তাতেই হবে।
.
নিয়ন্তার কথামতো ইরফান একটা পিড়ি নিয়ে তাতে বসে পড়লো।
নিয়ন্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।
আগে কেনো ভালোবাসার মানে বুঝেনি সে?
যদি বুঝতো এতো কষ্ট কি তাকে পোহাতে হতো?
তার একটা ভুলের জন্যই নিয়ন্তার জীবনটাও এলোমেলো হয়ে গেলো।
.
খানিকক্ষণ শান্তভাবে নিয়ন্তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সে বললো-
না নিয়ন্তা তোমার জীবনটা এলোমেলো হয়নি। আমি গুছিয়ে দিবো, সাজিয়ে দিবো।
.
ইরফানের দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
কিছু বললে?
.
মুচকি হেসে ইরফান বললো-
নাহ।
-কি খাবে বলো আজ দুপুরে?
-তুমি যা খাওয়াও।
-গরুর মাংস ভুনা আর পটল ভাজি চলবে?
-দৌড়াবে।
.
হালকা হেসে নিয়ন্তা আবারো কাজে মন দিলো।
.
এদিকে প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগের ঘটনা ভাবতে শুরু করলো ইরফান।
.
ইরফানের বাবার বন্ধু নিয়ন্তার বাবা।
ব্যবসার কাজের জন্য তিনি নিয়ন্তার বাবার কাছ থেকে প্রায় ২৩লক্ষ টাকা ধার নিয়েছেন।
বলেছিলেন ব্যবসায় সফলতা লাভ করার সাথে সাথেই তিনি টাকা পরিশোধ করবেন।
ধীরে ধীরে তার ব্যবসার উন্নতি হতে লাগলো। কিন্তু তিনি নিয়ন্তার বাবাকে টাকা পরিশোধ করেননি।
এভাবে প্রায় কয়েকবছর চলে যায়।
ইরফানের বাবার কাছে নিয়ন্তার বাবা এতোদিন যাবৎ টাকা খুঁজেও পায়নি। তাই তিনি ইরফানের বাবাকে জানিয়ে দিয়েছেন এবার যদি টাকা ফেরত না দেন তবে তিনি অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।
আর সেদিনই ইরফানের বাবা ইরফানকে ডেকে বললেন-
নিয়ন্তাকে তোর কেমন লাগে?
-ভালোই।
-বিয়ে করতে পারবি তাকে?
-এমনিতেই ভালো বলেছি বাবা। বিয়ে করার মতো ভালো সে অবশ্যই নয়।
-কেনো? খারাপ কি!
-কোঁকড়ানো চুল, শ্যামবর্ণ, আনস্মার্ট। সব মিলিয়ে খ্যাত একটা মেয়ে!
-তুই যদি নিয়ন্তাকে বিয়ে করিস তাহলে রিজাউল কে আমার টাকাটা ফেরত দিতে হবেনা আর। বেয়াইন এর কাছ থেকে নিশ্চয় টাকা ফেরত নিবে না রিজাউল।
-টাকার জন্য তুমি এমন একটা মেয়েকে....
-কয়েকবছর পর আমি অনেক টাকার মালিক হবো তখন নাহয় ছুড়ে ফেলিস ওই মেয়েকে। তাছাড়া ঘরে এমন বউ রেখে বাইরে ভালোই মাস্তি করা যায়। কারণ তুই যদি এমন মেয়েদের একটু ভালোবাসা দেখাস তারা এটা সত্যি ভেবে বসে থাকে।
-কিন্তু সে আমায় বিয়ে করবে? আর আঙ্কেল কেনো বিয়ে দিতে চাইবে তার সাথে?
-তুই নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ। যেকোনো মেয়েই তোর প্রতি দূর্বল হতে বাধ্য। আর এটাতো নিয়ন্তা!
তারপর কি যেনো বললি রিজাউল মানবে কিনা? নিয়ন্তাকে পটালে রিজাউল মানতে বাধ্য।
.
খানিকক্ষণ চুপ থেকে ইরফান বললো-
আমি রাজি বাবা।
.
.
কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিয়ন্তার সামনে গেলো ইরফান।
ইরফানকে দেখে নিয়ন্তা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-
ইরফান ভাইয়া, আপনি?
-এতো অবাক হওয়ার কি আছে?
-না মানে হঠাৎ এভাবে...
-তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো নিয়ন্তা।
-বলেন?
-আসলে এভাবে বলতে পারবোনা। ফোন নাম্বারটা দেওয়া যাবে তোমার?
.
খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিয়ন্তা বললো-
হু।
.
.
রাত ১২টা।
.
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন নিয়ন্তা।
কিন্তু হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠায় চোখ জোড়া বাধ্য হয়ে খুলতে হয় তার।
ফোন কানে নিয়ে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো-
হ্যালো, কে?
-আমি ইরফান।
.
ইরফানের নাম শুনে চমকে গেলো নিয়ন্তা।
শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
হালকা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বললো-
ভাইয়া আপনি?
-ইশ!
-কি?
-ভাইয়া বলো কেনো? বুকে লাগেতো।
-না মানে ছোট থেকেইতো বলতাম।
-তখন থেকেই বুকে লাগতো।
-বুঝলাম না?
-আর কবে বুঝবে নিয়ন্তা?
-কি?
-এই যে আমি তোমায় কতো ভালোবাসি।
.
ইরফানের মুখে আচমকা এমন একটা কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো নিয়ন্তা।
.
তার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ইরফান বললো-
আমি তোমাকে ছোট থেকেই ভালোবাসি নিয়ন্তা। হয়তো তোমাকে বুঝাতে পারিনি সেটা।
কিন্তু বিশ্বাস করো একটা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। এখন মনে হচ্ছে সেই উপযুক্ত সময় এসেছে।
.
এবারো সাড়া না পেয়ে ইরফান বললো-
শুনছো তুমি নিয়ন্তা?
.
শান্ত গলায় নিয়ন্তা বললো-
আমি পরে কথা বলি?
-ঠিক আছে।
.
ফোনের লাইন কেটে নিয়ন্তা ভাবতে লাগলো এতো ভালো একটা মানুষ কি করে হতে পারে! ভালোবাসে ছোট থেকেই কিন্তু প্রকাশ করছে এখন! চাইলেই ইরফান অনেক আগে থেকেই তাকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারতো কিন্তু জানায়নি। উপযুক্ত একটা সময়ের অপেক্ষা করেছে সে। এমন একটা ছেলেকে জীবনসঙ্গী করে পেলে এটাতো ভাগ্যের ব্যাপার!
.
নিয়ন্তার কথা ভেবে শয়তানি একটা হাসি দিলো ইরফান।
তার মতো ছেলের প্রস্তাব কখনো নিয়ন্তা ফিরিয়ে দিবেনা জানে সে।
আজ না হয় কাল তার প্রস্তাব গ্রহণ করবেই সে।
.
.
-ইরফান?
.
নিয়ন্তার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো ইরফান।
তার দিকে তাকিয়ে বললো-
হুম বলো?
-ভাবছি পটল ভাজি না করে আলু ভাজি করবো। ওটা তোমার প্রিয় বেশি তাইনা?
-হু।
.
নিয়ন্তা আলু নিয়ে আলুর খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ইরফান।
.
তখন জানতাম তুমি আমার প্রেমে পড়বে কিন্তু এটা জানতাম না প্রেমের অভিনয় করতে করতে আমিও তোমায় ভালোবেসে ফেলবো। ভালোবাসা শুধু রূপ দেখে হয়না, এই কথাটা যদি আগে বুঝতাম......
.
আপনমনে এসব ভেবে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো ইরফান।
.
ঠিক তখনি ফোন বেজে উঠলো নিয়ন্তার।
পাশেই রেখেছিলো নিজের মোবাইল সে। মায়ের ফোন দেখে রিসিভ করলো।
-কেমন আছিস মা?
-ভালো, তুমি?
-আছি। জামাই এর জন্য মনটা ছটফট করছে তাকে একটু দিবি।
.
মায়ের গলা শুনে ইরফানের দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
মা তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
.
ফিসফিস করে ইরফান বললো-
কিন্তু....
.
নিয়ন্তা ইশারা করে বললো-
অল্প একটু প্লিজ?
.
নিয়ন্তা ফোন বাড়িয়ে দিতেই ইরফান শ্বাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো-
আসসালামুআলাইকুম।
.
ইরফানের গলার আওয়াজ শুনেই পারভীন কবির বললেন-
তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো?
.
হালকা কেশে ইরফান বললো-
মা ঠান্ডা লেগেছে।
.
কথাটি বলেই আবারো কাশতে থাকলো ইরফান।
তা শুনে পারভীন কবির বললেন-
আচ্ছা আমি পরে কথা বলবো। নিজের যত্ন নিও বাবা।
-আচ্ছা মা।
.
ফোনের লাইন কেটে নিয়ন্তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে ইরফান বললো-
কেমন দিলাম?
.
নিয়ন্তাও হেসে বললো-
সেই!
.
.
হঠাৎ কলিংবেল এর শব্দ শুনতে পেলো তারা।
ইরফানের দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
তুমি বসো, আমি দেখছি।
.
.
দরজা খুলেই এলোকেশের সুন্দরী এক মেয়েকে দেখতে পায় নিয়ন্তা।
পরণে সালোয়ার কামিজ, ঘনকালো এলোকেশ, দেখতেও খুব মিষ্টি। কিন্তু কে এই মেয়েটি!
.
-ইরফান আছে?
.
মেয়েটির মুখে কথাটি শুনে নিয়ন্তা বললো-
আছে। কিন্তু আপনাকে চিনলাম না?
-আমি জয়া। ইরফান আমাকে চিনবে। আপনি?
-নিয়ন্তা।
-আপনি নিয়ন্তা!
-হুম, কেনো?
.
নিয়ন্তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে জয়া বললো-
নাহ, আমি ভেবেছি ইরাফানের বউ অনেক....
-কি?
-বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলবো?
-ওহ দুঃখিত! ভেতরে আসুন।
.
ভেতরে ঢুকে নিয়ন্তার উদ্দেশ্যে জয়া বললো-
ইরফান কোথায়?
-রান্নাঘরে ছিলো আমার সাথে। আমি ডেকে দিচ্ছি।
-না থাক। আমিই যাচ্ছি।
.
জয়া রান্নাঘরের দিকে এগুতে থাকলো।
তার দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বুঝতে পারলো এই মেয়ে তাহলে এই বাড়িতে আগেও এসেছে। কিন্তু কে সে?
.
আপনমনে এসব কথা ভেবে নিয়ন্তাও যেতে থাকলো রান্নাঘরের দিকে।
.
.
নিয়ন্তা যাওয়ার পর ইরফান বসা থেকে উঠে আলুর খোসা ছাড়াতে থাকলো, নিয়ন্তার একটু সাহায্য হলে ক্ষতি কি এটা ভেবে।
.
-এসব কি করছো তুমি ইরফান!
.
জয়ার কথা শুনে পেছনে তাকিয়ে চমকে গেলো ইরফান।
জয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-
জয়া, তুমি?
.
সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জয়া বললো-
যে ছেলে কিনা কাজের মেয়ে ছাড়া চলতেই পারতো না সে আজ কাজ করছে ঘরে একটা বউ থাকা স্বত্তেও!
.
তার কথা শুনে নিয়ন্তা হেসে বললো-
স্বামী যদি স্ত্রীকে সাহায্য করে এতে ক্ষতি কি!
.
কথাটি বলে ইরফানের দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
উনি কে ইরফান?
.
(চলবে)
Comments
Post a Comment