রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ৬)


---------তাহলে তোমার কথাই রইলো শারমিন। দুদিনের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে এই মেয়েকে ঘর ছাড়া করবো আমি।
আজহার হোসেন শেষের লাইনটা চেঁচিয়ে বলেন। নিজের রুমে থেকেও স্পষ্ট শুনতে পায় তা নিশুতি ইফতি। নিশুতি চিন্তায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে বিছানার এক কোণে। ইফতির মাথাটা ঝিমঝিম করছে রাগে। নিজের মায়ের প্রতিই ঘৃণা লাগছে তার। নিশুতি তার পেটের সন্তান না হোক,পিঠের তো! এতটুকুও কি দয়া মায়া নেই ওর প্রতি?
ইফতি বিছানার চাদর খাঁমচে ধরে। নিশুতির দিকে তাকিয়ে তেজী গলায় বলে,
--------তুই যেয়ে কিছু বলবি নাকি আমি কিছু বলবো?
নিশুতি দুর্বল গলায় বলে,
--------এদের কে বলে কিছু হবে বলে মনে হয় তোর?
ইফতি বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে,
---------তাহলে তুই বসে থাক। আমি যাচ্ছি।আমিই যা বলার বলবো।
নিশুতি ইফতির দিকে এগিয়ে এসে বলে,
--------আর কত লড়বি আমার জন্য? বাদ দে ভাই। কপালে যা আছে আমার তাই হবে। নিজেকে নিয়ে আমি আর ভাবি না।
ইফতি চেঁচিয়ে বলে,
-------কিন্তু আমি তো ভাবি। আমি তোকে নিয়ে যথেষ্ট ভাবি এবং ভাববো আজীবন। তুই একদম চুপ থাক । আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে আটকাতে আসবি না। বালের কপাল!!! আমি যাচ্ছি।
ইফতি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিশুতি উঠে এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়ায়। কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে ওপাশে কি কি হচ্ছে তা। না জানি এই ইফতি টা আবার কোন ঝামেলা লাগিয়ে দেয়!
নিশুতির ভয়ের চোটে শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়।
.
.
ইফতি আজহার হোসেন এর দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা বলে,
--------আম্মুর কথা শুনেই একদম আপুর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেছো আর আম্মুর কথায় কতটুকু যুক্তি আছে সেটা একটু খুটিয়ে দেখবা না??
পাশ থেকে শারমিন হোসেন চোখ রাঙানি দিয়ে উঠেন। ইফতি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। সে বলেই চলে,
--------সারাদিন আপু বাসার কাজ করে। একটা মানুষ সারাদিন কাজ করতে থাকলে দম বন্ধ লাগে তার। আপু তাই সকালে একটু দাঁড়িয়ে ছিল। তখন প্রায়াণ ভাইয়া ছাদে যায়। আর সে আপুর সাথে টুকটাক এদিক ওদিকের আলাপ করে। আর তাতেই একদম তাদের মধ্যে কিছু না কিছু আছে?? আব্বু কাকা তো মানা করে গেছিল আপুকে ঘরের একটা কাজও না করতে তবুও আপু করতেছে। কই সেটা কিছু না???
আজহার হোসেন ধমকে উঠেন ইফতিকে।
--------বয়স হবে ১৪-১৫ আর এখনি বাপ মায়ের মুখের উপর কথা বলিস?? শারমিন হোসেন ফোড়ন কাটেন।
--------আমার ভালো ছেলেটাকে ঐ ডাইনি মেয়ে নিজের বশে করে রাখছে। নাহলে দেখো না,ইফতি আগে আমাদের কত মান্য করতো। আর এখন!!
ইফতি দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে,
--------আগে ছোট ছিলাম তাই বুঝতাম না কে ভুল আর কে ঠিক!! কিন্তু এখন আমার বুঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আর এখন আমি বুঝি। আসলে যে তোমরাই ভুল সেটাও বুঝতেছি। আর তাই আমি আমার বোনের পক্ষে। অন্যায়ের পক্ষে আমি কোনোদিন ছিলাম না,থাকবো না।
আজহার হোসেন চট করে দাঁড়িয়ে ইফতির গালে থাপ্পড় মেরে বসেন।
-------বেয়াদব!! বাবা মায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না??
ইফতি গালে হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
--------আমি থাকতে এই বিয়ে আমি কখনো হতে দিবো না। আর তাতে আমি বেয়াদব হই আর যাই হই! আর আব্বু আম্মু মনে রাইখো,একদিন আপুর কাছেই তোমাদের ঠাই পাওয়া লাগবে।সেদিন আমিও আপুকে বলবো,যেন তোমাদের তাড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ঘিন আসে নিজের প্রতি!! আল্লাহ কি আর কোনো জায়গা পাইনি!? আমাকে এই পরিবারেই পাঠালো কেন!!
ইফতি আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। আজহার হোসেন ধপ করে সোফার উপর বসে পড়ে। শারমিন হোসেন বিলাপ পেড়ে বলেন,
--------এখনো সময় আছে। ঐ ডাইনির থেকে আমাদের ছেলেকে আলাদা করো। নয়তো ইফতি একদম যাবে আমাদের হাত থেকে।
আজহার হোসেন চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন,
--------হুম করবো।
.
.
.
রাত ১১ টা।
সেই সকালের পর থেকে আর একটাবারো নিশুতিকে দেখেনি প্রায়াণ। আজকে নিশুতি স্নুপির খবর টা পর্যন্ত নিতে আসেনি! সব ঠিক আছে তো? নিশুতি ঠিক আছে তো!
প্রায়াণের মনের ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। সে সাতপাঁচ না ভেবে সরাসরি ফোন লাগায় নিশুতির নাম্বারে। দুইবার রিং পড়ে পড়ে কেটে যায়। ওপাশ থেকে কেউ ফোন তোলে না। এবার প্রায়াণের টেনশন আরো বেড়ে যাচ্ছে। সে বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যেন নিশুতি ঠিক থাকে। সুস্থ থাকে।
সাড়ে ১১ টার দিকে প্রায়াণ আরেকবার কল করে নিশুতির নাম্বারে।
তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে নিশুতি ফোন তুলে।
ভাঙা গলায় বলে,
---------হ্যালো।
প্রায়াণের বুকের ভেতরে ধক করে উঠে। নিশুতির কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন!! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে তার।
প্রায়াণ তার চিন্তা প্রকাশ করে না নিশুতির কাছে। স্বাভাবিক গলায় বলে,
--------আজকে স্নুপিকে একবারও দেখতে আসলে না! স্নুপিও মন খারাপ করে বসে আছে তুমি আসোনি বলে। তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করি কেনো আসোনি!
নিশুতি বিরক্তির সুরে বলে,
---------ওওও....
প্রায়াণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
--------আর ইউ ওকে?
--------জ্বি। একটা কথা বলি?
--------হুম।
নিশুতি দম নিয়ে বলে,
--------আপনি আর কখনো আমাকে ফোন করবেন না। আমার সামনে আসবেন না। আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।
প্রায়াণের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়।
সে উদগ্রীব কন্ঠে বলে,
---------কেন? আমি কোনো ভুল করেছি নিশুতি?
---------না। কিছু করেন নি। জাস্ট এমনিই। যেগুলো বললাম,সেগুলো করলে ভালো হয়। রাখছি।
নিশুতি খট করে ফোনের লাইন কেটে দেয়। প্রায়াণের হাত থেকে ফোন টা বিছানার উপর ধপ করে পড়ে। প্রায়াণের উন্মাদ লাগছে নিজেকে। হঠাৎ কেন নিশুতি এমন কিছু বললো!! কি কারন তার??
.
রাত যত বাড়ে প্রায়াণের সিগারেট খাওয়া তত বাড়তে থাকে। বুকের ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কেউ যেন! নিশুতির বলা গোটাকতক লাইনে প্রায়াণের ফুসফুস জ্বলছে। ভীষণ জ্বলছে। সিগারেটও যেন আজ এই জ্বালা কমাতে পারছে না।
বারান্দায় উদাসী ভঙ্গিতে বসে সিগারেট টানছিল প্রায়াণ। ঠিক তখন স্নুপি আসে। এসে প্রায়াণের পায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আবার প্রায়াণের পায়ের সাথে নিজের গাল ঘষে ।
প্রায়াণ পরম আদরে কোলে তুলে নেয় স্নুপিকে। হাত থেকে সিগারেট টা ফেলে দেয়। স্নুপির লোমশ দেহে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
--------তোর মালকিন বোধহয় আমার হলো না আর স্নুপি। তাকে বুঝি হারিয়েই ফেললাম এবার...
.
.
সকাল বেলায় শারমিন হোসেন নিশুতির রুমে এসে নিশুতিকে ডাকে।
নিশুতি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে। হঠাৎ শারমিন কে দেখে ভীষণ চমকে যায় সে। প্রয়োজন ছাড়া এদিকে ভুলেও পা মাড়ান না তিনি। আজ আবার কি এমন দরকার পড়লো তার!
শারমিন হোসেন নিশুতির সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে বলেন,
-------নাস্তা খেয়েছিস? না খেলে খেয়ে নে। এরপর এই শাড়িটা পড়ে তৈরি হয়ে নে।
শারমিন হোসেন হালকা মিষ্টি কালারের একটা জামদানী শাড়ি নিশুতির হাতে ধরিয়ে দেয়।
নিশুতি এর মানে বুঝতে পারে। সে চুপ করে থাকে।
শারমিন হোসেন নিশুতির থুতনিতে হাত রেখে বলে,
---------সুন্দর করে তৈরি হবি কিন্তু। তাদের পছন্দ হলে আজকেই তোর বিয়ে হয়ে যেতে পারে।
শারমিন হোসেন খুশিতে গদগদ ভাব দেখিয়ে বেড়িয়ে যান রুম থেকে। নিশুতির শাড়িটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
এটা তার মায়ের শাড়ি। মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের সব জিনিস মেয়ের হয়। কিন্তু শারমিন হোসেন নিশুতিকে একটা জিনিসও দেয়নি তার মায়ের। সব নিজে লুফে নিয়েছেন।
নিশুতি আচমকাই কেঁদে উঠে। জানালা দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে বলে,
---------আমাকে একা ফেলে চলে গেলে মা? আমাকেও নিয়ে যেতে। জানো না এই নশ্বর পৃথিবীতে যার মা নেই,তার কিচ্ছু নেই। কেউ নেই। তার জন্য বরাদ্দ কোনো ভালোবাসা নেই। আমি মানা করেছিলাম সেদিন,যেও না আজ গ্রামে। দেশের অবস্থা খারাপ। কোথা থেকে কি হয় আবার! সেই তুমি গেলেই গেলে। আমাকে কেন রেখে গেলে ঢাকা? যাওয়ার পথে দুর্বত্তরা তোমাদের বাসে আগুন ধরিয়ে দিলো। তুমি একা মানুষ। কারো সাহায্য পেলে না। গাড়ির ভেতরেই জ্বলে পুড়ে মরলে! জানো মা যখন খবর এসেছিল তুমি আর নেই,আমিও আমাতে ছিলাম না সেদিন।হাত আছড়ে আছড়ে কেঁদেছি। সবার কাছে অনুরোধ করেছি আমার মাকে ফিরিয়ে আনো। কিন্তু কেউ আনতে পারেনি। মানুষ মরে গেলে নাকি আর আসে না! তুমি কেন মরে গেলে মা? আমার কি হবে,কার কাছে থাকবো,কিভাবে থাকবো একটা বার ভাবলে না? তুমি স্বার্থপর না,ভীষণ স্বার্থপর।
নিশুতি দেয়ালে পিঠ ঘেঁষে বসে কেঁদে চলে। বুকের ভেতর টা ছিড়ে যাচ্ছে তার। নিয়তি এত বড় খেলোয়াড় কেনো??
নিশুতির রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখে ইফতি। তারও যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। সে উল্টো দিক ঘুরে চোখ মুছে নিজের। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,যা কিছুই হয়ে যাক। এই বিয়েটা সে কিছুতেই হতে দিবে না।
.
.
১১ টা নাগাদ ছেলেপক্ষরা আসে দেখতে। নিশুতি ছেলেকে দেখে চমকে উঠে। বয়স কম হলেও ৪০ এর বেশি। এরকম একটা বুড়োর সাথে বিয়ে!!
শারমিন হোসেন খুশিতে ডগমগ হয়ে আছেন। এই বুড়োর গলায় নিশুতিকে ঝুলাতে পারলেই বাঁচেন তিনি। বুড়োর আরো দুই বউ আছে কিন্তু এবার তার চাই কচি মেয়ে। এর জন্য অবশ্য শারমিন হোসেন ভালো অংকের টাকাও পাচ্ছেন।
ছেলেপক্ষের পছন্দ হয় নিশুতিকে। তবে বিয়ে আজ না কাল। একটা প্রিপারেশন এর ব্যাপার আছে না! বুড়োর দুই বউ তো নিশুতিকে হাসি মুখে সতীন হিসেবে মেনেও নিয়েছে! নিশুতির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। এখন তার মনে হচ্ছে,নিয়তি খেলোয়াড় না,জানোয়ার!!
বিকেল বেলায় বারান্দায় চুপ করে বসে থাকে নিশুতি। আজ বাদে কাল তার বিয়ে! অথচ তার মধ্য নেই কোনো আনন্দ,নেই কোনো উল্লাস!
এভাবে তো সে চায়নি।
বিয়ে নিয়ে প্রতিটা মেয়ের একটা আলাদা স্বপ্ন,আলাদা উত্তেজনা থাকে। নিশুতিরও ছিল। খুব শখ ছিল তার,লালের বদলে নীল বেনারসি পড়বে সে। হালকা সাজেই নিজেকে মোহিত করে তুলবে। তার বর তাকে দেখবে আড়চোখে বারবার। আর নিশুতির চোখে ধরা পড়ে যেতেই নিশুতি মিষ্টি করে হাসবে।
ঈশ! কত স্বপ্ন....কত শখ....কত কিছু.....
কিন্তু পূরন হবে না হয়তো....
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)