ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১৬)


-৪৫০ কিলোমিটার আয়তনের শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। দেশের সবচেয়ে উন্নতমানের চা এখানেই উৎপন্ন হয়ে থাকে।
চা বাগান থেকে উৎপাদিত চায়ের মাধ্যমে সিলেট এদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে চলেছে। এই চা বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করছে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা। সুরমা অববাহিকা তথা সিলেটের আশেপাশের সব এলাকাই চা বাগানে আবৃত আর এ কারনেই চা বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সম্পদ।
বাংলাদেশের....
.
বর্ণের কথা শুনে নিয়ন্তা হেসে বললো-
আমিও কিন্তু সিলেটের মেয়ে। এসব আমি জানি।
-জানতে তো ভালোই।
বর্ষাকালে চা বাগানে আগে এসেছো?
-আসিনি।
-বর্ষায় চা বাগানের সৌন্দর্যের একটা আলাদা রুপ ধারন করে থাকে। সবুজ গালিচার উপরে যেনো কুয়াশার ছাউনি। উপলব্ধি করতে পারছো কি?
-এতো বকবক করতে থাকলে কিভাবে করবো?
.
নিয়ন্তার কথা শুনে চুপসে গেলো বর্ণ। চুপচাপ অন্য দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
.
নিয়ন্তা চোখ জোড়া বন্ধ করে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে লাগলো।
একপর্যায়ে বর্ণের দিকে তাকিয়ে বললো-
উপলব্ধি করলাম, বর্ষায় আসলেই অন্যরকম সৌন্দর্য্য ধারণ করে চা বাগান।
.

.
মাইলের পর মাইল পাহাড় ঘেরা চা বাগানের ভেতরে বর্ণের সাথে হাটতে লাগলো নিয়ন্তা।
সবুজের মেলা চা বাগানের অভ্যন্তরে বর্ণের সাথে প্রবেশ করে সবকিছু যেনো ভুলে গেলো নিয়ন্তা। এই মুহুর্তে শুধু বর্ণের সাথে সবুজের অবারিত সৌন্দর্য্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার।
কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ বর্ণকে চুপচাপ দেখে নিয়ন্তা ভ্রু কুচকে বললো-
মুখে কুলো দিয়েছো নাকি? চুপ কেনো?
-তুমিই তো বললে আমি বকবক করছি তাই কিছু উপভোগ করতে পারছো না।
-তাই বলে আর কথা বলবেনা!
-আমি আমার কাজ করছি।
-কি?
-তোমাকে দেখছি। তুমি প্রকৃতি দেখছো আর আমি তোমাকে।
.
বর্ণের কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলো নিয়ন্তা।
শান্ত গলায় সে বললো-
আমাকে দেখে কি মজা পাচ্ছো?
-মজা পাচ্ছিনা, শান্তি পাচ্ছি।
.
এই প্রথম বর্ণকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলো নিয়ন্তা।
মুখে চাপ দাড়ি, সরু নাক, চোখ গুলো বিড়ালের চোখের মতো। সব মিলিয়ে একজন সুদর্শন পুরুষ বলাই যায় তাকে। কিন্তু এই ছেলেটা তার প্রেমে পড়ার কারণ কি!
আর না ভেবে তাকেই নিয়ন্তা প্রশ্ন করলো-
তুমি তো বেশ সুন্দর। আমার প্রেমে পড়ার কারণ কি?
-তোমার মাঝে কি আছে তুমি নিজেও জানোনা। আমি তো তোমার চেয়ে মায়াবতী, সুন্দরী আর কোনো মেয়েই দেখেনি।
আর তাই হয়তো তোমার প্রেমে পড়েছি। আমার ভালোবাসা সত্যি ছিলো বলেই তোমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি আমি। একটা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পেরেছি আমরা। আর এই সম্পর্কের জোরেই তুমিও আমাকে একদিন ভালোবাসবে আমি জানি।
.
বর্ণের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলো নিয়ন্তা। এই মুহুর্তে তার কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছেনা সে।
তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বর্ণ বললো-
খিদে পায়নি?
-নাহ।
-তোমাকে আজ পানসী রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে যাবো।
-ওখানের কাচ্চি বিরিয়ানি টা সেই।
-খাবে আজ?
-পানসীতে যাবো আর কাচ্চি খাবোনা! তা হয় নাকি!
-ঠিক আছে। বিখ্যাত সাত কালার চা খেয়েছো?
-না তবে অনেক শুনেছি এই চায়ের কথা।
-পানসীর পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট এ পাওয়া যাবে এটা।
-আমি খাবো আজ।
-এতো বিশ্রী! এই জিনিসে কেনো এতো হাইপ আমার মাথায় ঢুকলো না। তুমি খেয়ে দেখিও তোমার কেমন লাগে।
-যেভাবে বলেছো আর খেতে ইচ্ছে করছেনা।
.
কথাটি বলে নিয়ন্তা সামনের দিকে এগুতেই হোচট খেয়ে তার জুতো ছিড়ে গেলো।
তা দেখে নিয়ন্তার মুখটা একেবারেই চুপসে গেলো।
বর্ণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো।
নিয়ন্তা তার দিকে তাকিয়ে বললো-
আমার দুঃখে তোমার মজা লাগছে?
-হু লাগছে তো। উঁচু জুতো পরোনি তাও হাটতে গিয়ে হোচট খাচ্ছো।
.
বর্ণের কথা শুনে মুখ বাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
এখন কি করবো? আশেপাশে দর্জিও পাওয়া যাবেনা।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে হাসতে হাসতেই বর্ণ বললো-
জুতা ছেড়ার শোকে পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি? দর্জি নয় মুচি হবে।
.
বর্ণের কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলো নিয়ন্তা।
অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
এখন আমি কি করবো?
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বর্ণ বললো-
তোমার শাড়ির কোথাও পিন মেরেছো কি?
-হুম।
-একটা খুলো।
-কেনো?
-ওই পিন দিয়ে তোমায় গুতো দিবো তাই।
-মানে?
-আরেহ! জুতোর মধ্যে লাগাবো।
-এভাবে ঠিক হবে?
-অন্তত এখান থেকে বের হওয়া পর্যন্ত ঠিক থাকলেই হলো। বউকে নতুন জুতো কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে।
.
বর্ণের হাতে নিয়ন্তা সেফটি পিন দিতেই বর্ণ নিচু হয়ে নিয়ন্তার পা থেকে ছিড়ে জুতোটা খুলে নিলো নিজেই।
পিন দিয়ে খুব সহজেই জুতোটা ঠিক করে নিলো সে।
নিয়ন্তার পায়ে জুতো পরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত দিতেই নিয়ন্তা বলে উঠলো-
আমি পারবো থাক।
-খুলে যখন দিতে পেরেছি, পরিয়েও দিতে পারবো।
-তখন হুট করে খুলেছো। তাই কিছু বলার সুযোগ পাইনি।
কিন্তু এখন...
-কি?
-আমি পারবো।
.
নিয়ন্তার কথা না শুনে বর্ণ তার পায়ে এক প্রকার জোর করেই জুতো ঢুকিয়ে দিতে দিতে বললো-
পিনটায় ব্যথা পাও কিনা দেখোতো নিমপাতা।
.
.
.
সেই জায়গায় সেই একই শাড়ি পরিহিতা নিয়ন্তা আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তার পাশে নেই শুধু বর্ণ।
এখানে পা দিতেই এতোক্ষণ বর্ণের সাথে কাটানো দিনটার মাঝে ভাবনায় ডুবে ছিলো নিয়ন্তা। সেই দিনটা কখনো তার মন থেকে মুছবেনা। এর আগেও সে অনেকবার এই জায়গায় এসেছিলো কিন্তু বর্ণের সাথে এসেই সে এই জায়গাটার সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলো।
.
হঠাৎ একটা হালকা বাতাস বয়ে নিয়ন্তার সারা শরীর স্পর্শ করে যায়। যে বাতাসে তার শরীর শিহরিত হয়ে উঠে।
কেনো যেনো মনে হচ্ছে বর্ণ তার খুব পাশেই। আসলে কি রয়েছে?
.
চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা হাতের আঙুল দিয়ে মুছে নিয়ন্তা বললো-
তুমি কি আছো? আমি জানি তুমি আমার আর কোনো ক্ষতি করবেনা। তাই আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছিনা বর্ণ।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা একটা দম ফেলে নিয়ন্তা আবারো বললো-
তুমি তো বেঁচে থাকতেই আমার অনেক বড় ক্ষতি করে দিয়েছো বর্ণ। তাই তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে আমি একটুও অনুতপ্ত নয়, একটুও।
.
কথাটি বলেই নিয়ন্তা হনহন করে হেটে সামনের দিকে এগুতে থাকলো, খুঁজতে লাগলো ইরফানকে।
.
.
.
আলিনাকে কোলে তুলে তার কপালে একটা চুমু খেয়ে ইরফান বললো-
আজ খুশি তো আমার মা?
.
খিলখিল করে হেসে আলিনা বললো-
অনেকগুলা খুশি আমি বাবাই।
-তাহলে তুমি একটু ওদিকটাই খেলতে যাও। আমি তোমার আম্মুর সাথে একটু কথা বলি?
-ঠিক আছে।
.
আলিনাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো ইরফান। সে দৌড়ে সামনের দিকে যেতেই প্রিয়ার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে আনলো ইরফান।
প্রিয়া তার বুকে মুখ লুকিয়ে বললো-
আর কতো সহ্য করবো আমি এসব বলতে পারো? নিজের স্বামী কে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখতে কি আমার ভালো লাগছে? মোটেও লাগছেনা।
.
প্রিয়ার মুখটা নিজের দিকে এনে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে ইরফান বললো-
আর বেশিদিন নেই। আমি শুধু তোমারই থাকবো।
.
কথাটি শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়া।
.
পেছন থেকে এমন দৃশ্য দেখে নিয়ন্তার পায়ের তলার থেকে যেনো মাটি সরে যেতে চায়ছে।
স্থির হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি টুকুও সে হারিয়ে ফেলেছে।
এতো বড় বাগানে ইরফানকে খুঁজে পাবেনা বলে মাত্রই ব্যাগ থেকে নিজের মোবাইল বের করেছিলো নিয়ন্তা। কিন্তু সামনেই যে প্রিয়ার সাথে এমন অবস্থায় ইরফানকে দেখতে পাবে ভাবেনি সে।
.
শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা চেপে কান্নার শব্দ আড়াল করে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলো নিয়ন্তা।
একটা সি.এন.জি ঠিক করে রওনা হলো সে হুসাইন পুরের উদ্দেশ্যে।
.
.
পরণের শাড়ি শরীর থেকে টেনে খুলে দরজার দিকে ছুঁড়ে মারলো নিয়ন্তা। আজকের মত এতোটা অসহায় এর আগে কখনো লাগেনি তার। রাগে নিজের শরীরে নিজের কামড়ে খেলেও এখন কম হবে বলে মনে হচ্ছে নিয়ন্তার। কি করলে নিজেকে এখন শান্ত করতে পারবে বুঝতে পারছেনা সে।
নিজের রুমের বিছানার উপরে বসে পড়লো নিয়ন্তা।
সে ভেবেছিলো জয়া মেয়েটার সাথে ইরফানের কোনো না কোনো সমস্যা নিশ্চয় আছে। কিন্তু প্রিয়া যে ইরফানের স্ত্রী এটা সে ভাবেনি।
যদি তাই হয়ে থাকে তবে কেনো ইরফান তাকে বিয়ে করলো? কেনো নাটক করলো ভালোবাসার! আর কেনোই বা প্রিয়া সবটা জেনে চুপ হয়ে আছে?
এর পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে!
সে কি এই রহস্য উদঘাটন করতে পারবে ?
.
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)