ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ৩)
আঁড়চোখে ভেতরে তাকিয়ে নিয়ন্তা কে দেখতে পেলো প্রিয়া।
হালকা হেসে ইরফানের উদ্দেশ্যে বললো-
তোমার স্ত্রী পেছনে।
.
প্রিয়ার মুখে নিয়ন্তার কথা শুনে ইরফান গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলে উঠলো-
প্রিয়া ভেতরে আসো! দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি।
.
মুচকি হেসে প্রিয়া বললো-
তোমার বউ এর সাথে দেখা করার জন্যইতো আসলাম।
ভেতরে না এসে কি চলে যাবো!
.
ইরফানের পাশ কাটিয়ে প্রিয়া ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে।
নিয়ন্তাও এগিয়ে আসলো তার দিকে।
প্রিয়া তার পাশে গিয়ে বললো-
কেমন আছো?
-ভালো, আপনি?
-ভালোই। তোমার কথা অনেক শুনেছি।
-কিন্তু আমি আপনার কথা শুনিনি।
-আমি প্রিয়া। তোমাদের প্রতিবেশী।
.
আর কিছু বলার আগেই প্রিয়ার ফোন বেজে উঠলো।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে বললো-
কি হয়েছে রকি?
.
ফোনের ওপাশ থেকে কে কি বলেছে শুনতে পেলোনা নিয়ন্তা।
প্রিয়া ফোন রেখে বললো-
আজ আমায় যেতে হবে।
-সে কি! মাত্রই এলেন!
-ইচ্ছে ছিলো সময় কাটানোর তোমার সাথে, তবে এখন যেতে হবে আমায়।
-কিন্তু.....
-তোমার বাসার পেছনের গলির ডান দিকেই আমার বাড়ি। আলিনা ভুবন বাড়ির নাম। এসো সময় করে।
-আলিনা ভুবন কেনো?
-আজ আসছি।
.
আর কোনো কথা না বলে প্রিয়া দ্রুতবেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে থাকলো।
.
তার পথের দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
অদ্ভুদ!
.
দরজা আটকিয়ে ইরফান প্রশ্ন করলো-
কি?
-হুট করে একটা মেয়ে এলো। কোনো কথা না বলে আবার হন্তদন্ত করে চলে গেলো।
-হুম।
-কে এই মেয়েটি?
-প্রিয়া।
-সেটাতো সেই বলেছে, কিন্তু তোমার সাথে তার কি সম্পর্ক?
.
নিয়ন্তার কথা শুনে ইরফান বললো-
আমার সাথে কি সম্পর্ক মানে! বলেছে শুনোনি? পেছনের গলিতে বাসা। তার মানে প্রতিবেশী।
-ওহ।
.
ইরফান সোফায় বসলো হেলান দিয়ে।
নিয়ন্তা তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
মেয়েটা ভারী সুন্দরী। যে কারো প্রিয়া সে সহজেই হতে পারবে।
-হুম।
-হুম মানে?
-ঠিক বলেছো।
.
এপর্যায়ে গম্ভীরমুখে নিয়ন্তা বললো-
যে কারো মানে কি তোমারো পারবে?
.
মুখে বিরক্তিভাব এনে ইরফান বললো-
কি যে বলোনা!
-তুমি বলো ইরফান?
তোমার প্রিয়া সে হতে পারবে?
.
এবার ধমকের সুরে ইরফান বললো-
কি শুরু করেছো কি তুমি!
সবাইকে নিজের মতন মনে করো?
-নিজের মতো মনে করি মানে?
-না বুঝার কিছু নেই নিয়ন্তা।
-এতো ভণিতা না করে কে এই মেয়ে বললেই হয়না?
-না হয়না। আমি বলবোনা। কি করবা তুমি?
.
ইরফানের কথা শুনে ছলছল চোখে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
কিছুনা।
.
ইরফান পকেট থেকে মোবাইল বের করে গেইমস খেলায় মনোযোগ দিলো।
এদিকে নিয়ন্তা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নিজের রুমের দিকে।
.
.
.
ওই মেয়েটাকে দেখে ইরফানের ব্যবহার নিমিষেই বদলে গেলো।
তার মানে কোনো একটা গোলমাল নিশ্চয় আছে। কিন্তু কি?
আমি কি খুব বেশি ভাবছি? যা ভাবছি তা হয়তো না। ইরফান আমাকেই ভালোবাসে, যেমনি হয়না কেনো আমি। হয়তো প্রিয়ার মতো সুন্দরী নয় কিন্তু ইরফানের কাছে তার চেয়েও বেশি সুন্দরী।
আর কতো কি করলে ইরফানের ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ থাকবে না আমার!
ইরফানকে নিয়ে এসব ভাবা কি ঠিক হচ্ছে!
.
এসব ভেবে বসা থেকে উঠে বসলো নিয়ন্তা।
ঠিক করলো এখুনি ইরফানের কাছে যাবে।
.
এক পা বাড়াতেই তার মনে পড়লো ইরফানের বলা কথাটি-
সবাইকে নিজের মতন মনে করো?
.
আর যাই হোক এটা না বললেও পারতো ইরফান। কোন অর্থে বলেছে সে এই কথাটি? একটাবার জিজ্ঞাসা করে দেখবো?
হুম করেই দেখি।
.
আপনমনে এসব ভেবে নিয়ন্তা এগিয়ে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে।
.
.
.
ইরফানের দিকে সোজা এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ফেললো নিয়ন্তা।
নিয়ন্তার এমন কান্ডে ইরফান তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
উহু! দিলেতো সব শেষ করে?
-নিয়ন্তা বড় নাকি গেইম বড়?
.
নিয়ন্তার কথা শুনে হালকা হেসে ইরফান বললো-
অবশ্যই তুমি।
.
ইরফানের মুখের হাসি দেখে যা বলতে এসেছিলো সেসব কিছুই বলতে ইচ্ছে হলোনা নিয়ন্তার।
নিজেও হেসে বললো-
রান্না করবো। সাহায্য করবে চলো।
-আমায় করতে হবে?
-আর কে করবে শুনি! চলেন সাহেব।
.
.
.
রাত ১০টা....
ইরফানের সাথে থাকলে সময়টা কখন কিভাবে চলে যায় বুঝতেই পারেনা নিয়ন্তা।
.
ড্রয়িংরুমে বসেছিলো দুজনে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
রাত ১০টা হলো। খাবেনা?
-হুম।
-তুমি তাহলে বসো আমি খাবার গরম করে নিয়ে আসছি।
-ঠিক আছে।
.
নিয়ন্তা এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে।
দুপুরে ইরফানের সাথে খুনসুটি করে রান্নাটা সেরেছিলো সে।
ইরফান ভালোই পারে মেয়েদের এসব কাজ, জানতোনা নিয়ন্তা।
অবশ্য শুনেছিলো তার কাছে।
.
ভাবতে ভাবতেই চুলায় আগুন জ্বালালো নিয়ন্তা।
কিন্তু পেছন থেকে তার কোমর চেপে কেউ একজন জড়িয়ে ধরলো তাকে।
.
ভয়ার্ত কণ্ঠে নিয়ন্তা প্রশ্ন করলো-
কে?
.
ইরফান তার মুখটা নিয়ন্তার কানের পাশের নিয়ে ফিসফিস করে বললো-
আমি ছাড়া কে হতে পারে? হুম?
.
কথাটি বলেই নিয়ন্তার কানের লতিতে ঠোঁট জোড়া ছুইয়ে দিলো ইরফান।
.
সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো নিয়ন্তার সারা শরীর।
ইরফান তার অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে আরো জোরে চেপে ধরে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিয়ন্তা বললো-
আহ ইরফান! কি করছোটা কি এই সময়ে। ভাত খাবেনা?
-উহু! রোমান্সের আবার সময় অসময় আছে নাকি?
-তাই বলে এখন?
-হু।
-ভাত খেয়ে না হয়....
-ততক্ষণে যদি মুড চলে যায়?
-কিন্তু ক্ষুদা লাগবেতো।
-যেটার ক্ষুদা লেগেছে ওটা মিটাও।
.
আর কোনো কথা না বলে নিয়ন্তাকে কোলে তুলে নিলো ইরফান।
ধীরপায়ে এগিয়ে যায় সে নিজেদের রুমের দিকে।
.
.
.
আয় আয় চাঁদ মামা
টিপ দিয়ে যা।
চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।
ধান ভানলে কুঁড়ো দেব,
মাছ কাটলে মুড়ো দেব,
কাল গাইয়ের দুধ দেব,
দুধ খাবার বাটি দেব,
চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।
.
কারো আদুরী গলায় এই ছড়াটি শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় নিয়ন্তার।
.
এক লাফেই বিছানা থেকে উঠে পড়লো সে। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে ইরাকে। কিন্তু ড্রিম লাইটের আলোয় সবটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিকে। তাই এগিয়ে গিয়ে লাইটের সুইচ অন করলো সে।
সাথে সাথেই ইরফান বলে উঠলো ভাঙ্গা গলায়-
কি হয়েছে? লাইট কেনো জ্বালালে?
-আসলে তখন চুলা বন্ধ করে আসিনি। তুমি ঘুমাওনি?
-আমার ঘুম পাতলা। লাইট জ্বালানোর কারণে...
-বুঝতে পেরেছি। তুমি খাবে কিছু?
.
চোখ জোড়া বন্ধের মাঝেই মুচকি একটা হাসি দিয়ে ইরফান বললো-
মাঝেমাঝে মন ভরলেই চলে সাহেবা। পেট না ভরলেও চলবে।
.
ইরফানের কথায় মুচকি হেসে নিয়ন্তা বললো-
ঘুমাও। চুলাটা বন্ধ করে আসি।
ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো নিয়ন্তা পানি খাওয়ার জন্য।
কিন্তু টেবিলের উপর জগটা পেলোনা সে। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে সে টেবিলের উপরেই পানির জগ রেখেছিলো। তাহলে কোথায় গেলো সেটি!
.
আপনমনে এসব ভেবে নিয়ন্তা এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।
আরো অবাক হলো সে চুলাটা বন্ধ দেখে। কি করে এটা সম্ভব!
সাথে সাথেই নিয়ন্তা শুনতে পেলো ঢকঢক করে কারো পানি পান করার শব্দ। পেছনে ফিরতেই সে দেখতে পেলো র্যাকের পাশে বসে জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে ইরা।
এমন একটা দৃশ্য দেখে যেখানে নিয়ন্তার ভয় করার কথা সেখানে সে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো-
আমার ইরা!
.
ইরার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই ইরফানের গলার স্বর শুনতে পেলো নিয়ন্তা।
-আমি পানি খেতে এলাম।
.
ইরফানের দিকে তাকিয়ে আবার ইরার দিকে তাকাতে গিয়ে নিয়ন্তা দেখলো, র্যাকের পাশে খালি জগটা ছাড়া কিছু নেই।
.
এটা কি করে সম্ভব। এখুনি ইরা ছিলো। ১সেকেন্ড এর মধ্যেই কোথায় গেলো সে!
.
-নিয়ন্তা?
.
ইরফানের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো নিয়ন্তা।
তার কাছে সবটা চেপে গেলো সে। শান্ত গলায় বললো-
হুম দিচ্ছি।
-এখন থেকে বিছানার পাশে একটা বোতল রাখবা পানির। নাহলে আজকের মতো রাত ৩টাই ঘুম ভাঙ্গলে পানির জন্য কষ্ট করে উঠতে হবে।
-হু।
.
.
.
ঘড়িতে সময় সকাল ৭টা.....
বাইরের পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে ইরফানের।
চোখ জোড়া খুলে সে পাশে তাকাতেই দেখলো নিয়ন্তা নেই।
উঠে বসলো ইরফান।
উচ্চশব্দে বলে উঠলো-
নিয়ন্তা? এই নিয়ন্তা?
.
নিয়ন্তার কোনো সাড়া না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ইরফান।
এগিয়ে যায় সে ড্রয়িংরুমের দিকে।
.
.
সারাবাড়ি খুঁজেও সে নিয়ন্তাকে পেলোনা। মোবাইল টাও বিছানার উপরে পড়ে রয়েছে। ।
কোথায় গেলো এই মেয়ে?
.
(চলবে)
Comments
Post a Comment