রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ৪)


মিনু শেখের মেজাজ ভীষণ গরম হয়ে আছে। কম হলেও ৬-৭ বার ডেকেছে প্রায়াণ কে। কিন্তু তার উঠার নাম নেই। যখন ডাকে তখন একটু নড়েচড়ে উঠে। এরপর যেই লাউ সেই কদু...!
আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আজকে ভার্সিটিতে পরীক্ষা আছে ছেলেটার অথচ কোনোভাবেই উঠাতে পারছে না একে!!
প্রেমা আসে। বলে,
-------মা তুমি যাও। আমি তুলে দিচ্ছি ভাইয়া কে।
মিনু শেখ কপাল কুঁচকে বলেন,
--------আমিই যখন পারতেছি না তুই কিভাবে পারবি?
--------সে আমার ব্যাপার। তুমি যাও না,আমি তুলে দিবো প্রমিস।
মিনু শেখ খানিকক্ষণ প্রেমার দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যান। প্রেমা স্মিত হেসে নিজের মুখ টা প্রায়াণের কানের কাছে নিয়ে বলে,
--------নিশুতি এসেছে ভাইয়া। রঙ চা নিয়ে, খাবে না??
কথাটা যেন কারেন্টের মতো খেলে যায় প্রায়াণের মস্তিষ্কে। এক লাফে উঠে বসে বিছানায়। প্রেমা হোহো করে হেসে উঠে।
প্রায়াণ ব্যস্ত গলায় বলে,
-------কই? কোথায় এসেছে?
-------এসেছ তোমার স্বপ্নে!! উঠছিলে না তাই এই টেকনিক ইউজ করলাম। এবার উঠো। তোমার না আজকে পরীক্ষা?
প্রায়াণ রেগে যায়। বালিশ ছুড়ে মারে প্রেমার মুখের উপর।
-------তোর থোবরা টা ভেঙে দেওয়া উচিত বুঝলি?? ইডিয়ট।
প্রায়াণ গজগজ করতে করতে উঠে বাথরুমে যায়। প্রেমা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় বিছানায়। পিউ রুমে ঢোকে। প্রেমা কে একা এভাবে হাসতে দেখে বলে,
-------জ্বীনে ধরছে তোরে আপু? এমনে হাসতেছিস ক্যান?
প্রেমা হাসি বিলীন করে বলে,
-------এমনেই। তোকে বলতে হবে?
-------বল না,বল না.. আমিও শুনি। আমিও হাসি একটু..!
প্রেমা পিউ'র চুল টেনে বলে,
--------সর এখান থেকে। এত হাসতে ইচ্ছা করলে একা একা গিয়ে রাস্তায় বসে হাস। মানুষ পাগল মনে করে দু চার টাকা ফেলে দিবেনি চিকিৎসার জন্য!
প্রেমা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর পিউ গাল নাক ফুলিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
-------আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি দেখে আমাকে এত ইগনোর করিস না??? কুত্তি বিলাই একটা..
.
.
প্রায়াণ ফ্রেশ হয়ে মুখে পাউরুটি গুঁজে মিনু শেখের উদ্দেশ্যে বলে,
--------আম্মু গেলাম। দোয়া করিও।
মিনু শেখ প্রেমার মাথায় তেল লাগাচ্ছিল। সে উঠে এসে প্রায়াণের কপালে চুমু দিয়ে বলে,
--------ভালো ভাবে পরীক্ষা দে দোয়া করি আব্বাজান।
প্রায়াণ বের হতে নিতেই পিউ এসে চেঁপে ধরে তাকে।
--------ভাইয়া ২০ টা টাকা দিয়ে যা না...
---------টাকা দিয়ে কি করবি??
---------ফুচকা খাবো। দে না।
প্রায়াণ মুখ বাকিয়ে বলে,
--------আমার কাছে টাকা নাই। যা সর।
পিউ চোখ গরম করে বলে,
--------দিবি না??
--------নায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
পিউ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
--------ওকে ফাইন। আমিও আম্মুকে বলে দিবো যে তুমি সিগারেট খাও লুকিয়ে লুকিয়ে। আর আম্মু আমার কথা কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করে হু...
প্রায়াণ পিউ'র মুখ চেঁপে ধরে বলে,
-------অনেক হারামী হয়ে গেছিস। টাকার জন্য নিজের ভাইকে ব্ল্যাকমেইল করিস!! লজ্জা করে না তোর?
পিউ মাথা এপাশ ওপাশ করে বলে,
--------উহুঁ না। একদম লজ্জা করে না।
প্রায়াণ মানিব্যাগ থেকে ২০ টাকার একটা নোট বের করে পিউ'র হাতে গুঁজে দেয়। পিউ প্রায়াণের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
---------আমার লক্ষী ভাইয়া। কত্ত ভালো তুমি!
---------হইছে ঢং করিস না! দরজা লাগিয়ে দে। বায়।
প্রায়াণ বেরিয়ে যায়। পিউ দরজা লাগিয়ে দেয়।
.
প্রায়াণ বের হতেই নিশুতিদের বাসার দরজা টাও খুলে কেউ। প্রায়াণ দাঁড়িয়ে থাকে এই ভেবে যদি নিশুতির সাথে দেখা হয়ে যায়! হয়োও তাই।
এক বালতি কাপড় চোপড় নিয়ে নিশুতি বের হয়।
কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে,পায়জামার কিছু অংশ ভেজা। প্রায়াণ বুঝে এতসব কাপড় নিশুতিই ধুয়েছে। প্রায়াণের খুব রাগ হয় নিশুতির উপর। তার ইচ্ছে হয় খুব কড়া করে বকে দিতে নিশুতি কে। কিন্তু কোন অধিকারে বকবে সে...?
নিশুতি প্রায়াণ কে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-------গুড মর্নিং ভাইয়া। কোথায় যাচ্ছেন এই সকাল সকাল?
--------ভার্সিটিতে। আজকে এক্সাম আছে আমার।
-------ওহ। আচ্ছা একটা জিজ্ঞেস করবো?
-------হুম।
-------কোন ভার্সিটিতে পড়েন?
--------ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাইক্রোবায়োলজি সাবজেক্ট নিয়ে।
নিশুতি চোখ বড়বড় করে বলে,
---------বাহ বাহ! কত্ত ভালো জায়গায় পড়েন আপনি!
প্রায়াণ উত্তর দেয় না। স্মিত হাসে শুধু।
নিশুতি বলে,
--------তাহলে যান ভাইয়া। দোয়া করি আপনার এক্সাম ভালো হোক।
প্রায়ান মনে মনে বলে,
--------তুমি যখন দোয়া করছো তখন এক্সাম তো ভালো হবেই নিশুতি।
মুখে বলে,
-------থ্যাংকস।
-------ওয়েলকাম ভাইয়া।
নিশুতি বালতি নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। প্রায়াণ অপলক দৃষ্টিতে নিশুতির দিকে তাকিয়ে থাকে। একদম নর্মাল ভাবেও নিশুতিকে কী দারুণ লাগে দেখতে!
প্রায়াণ বিরবির করে বলে,
-------তুমি একটা মায়াবতী নিশু। আর তোমার মায়ার জালে আমাকে আটকে ফেলছো ধীরে ধীরে...
.
.
প্রেমা কলেজ গেলো কিছুক্ষণ আগে। সে এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। নিশুতির থেকে ছোট হলেও তার আর নিশুতির মধ্যকার সম্পর্ক একদম বেস্ট ফ্রেন্ড এর মতোন। একে অপরকে তুই করেই বলতে পছন্দ করে তারা।
প্রত্যুষ অফিস গেছে অনেক সকালে। আজকে নাকি কিসের প্রেজেন্টেশন আছে তার। এই প্রেজেন্টেশন টা ভালো ভাবে কমপ্লিট করতে পারলে প্রত্যুষের প্রমোশন হবে অনেক উঁচু পোস্টে।
মিনু শেখ দুই ছেলের জন্যই মনে মনে দোয়া করছেন আর কাপড় ভাঁজ করছেন।
পিউ আজ বাসায়। স্কুল বন্ধ তার।
ঘরে একা একা একটুও মন টিকছে না। তাই মায়ের কাছে আসে গল্প করার জন্য।
--------মা চলো না গল্প করি।
--------এখন না পড়ে। আমার হাতে অনেক কাজ আছে পিউ।তার উপর কত টেনশন! আর ভালো লাগে না।
পিউ মায়ের পাশ ঘেঁষে বসে বলে,
--------কিসের টেনশন আম্মু??
--------এই যে সংসারে টেনশনের অভাব আছে! যখন তোদের সংসার হবে,তখন বুঝবি এসব। এছাড়াও প্রত্যুষের বিয়ে নিয়েও কত চিন্তা। কোথায় একটা ভালো মেয়ে পাবো কে জানে! আজকাল তো তেমন ভালো ঘরোয়া মেয়ে পাওয়াই যায় না।
পিউ চুপ করে ভাবে কিছু। তারপর বলে,
--------মা বাসায়ই যখন মেয়ে আছে তখন বাহিরে কেন খোজাখুজি??
মিনু শেখ কপাল কুঁচকে বলেন,
--------মানে?
--------মা নিশুতি আপু। সে তো ঘরের সব কাজ জানে। আবার পড়াশোনাতেও ভালো। দেখতেও সুন্দর। তাকে বড় ভাইয়ার বউ করে আনলে কেমন হয়? এতে মেয়েটার কষ্ট টাও কমতো..
মিনু শেখ পিউ'র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
-------কত বুদ্ধি তোর! আমি তো ভেবেই দেখিনি এসব। নিশুতিকে আমারো খুব পছন্দ। আমার মনে হয় প্রত্যুষ ও ওকে পছন্দ করবে। আমি আজকেই তোর বাপের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলে দেখবো।
পিউ খুশি হয় মনে মনে খুব। নিশুতি এই ঘরের বউ হলে ব্যাপার টা মন্দ হবে না। তার কাছেও নিশুতিকে অনেক ভালো লাগে। মেয়েটার মধ্যে একটুও অহংকার নেই। বেশ মিশুক....
.
.
পরীক্ষা শেষ আরো অনেক আগে। ক্যাম্পাসে বসে আছে প্রায়াণ। অহরহ বন্ধু বান্ধব থাকলেও তার কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বারবার নিশুতিকে মনে পড়ছে তার।
একবার ফোন দিয়ে দেখলে কেমন হয়??
প্রায়াণ কালকে প্রেমার ফোন থেকে নিশুতির নাম্বার টা নিয়ে রেখেছিল তার কাছে।
প্রায়াণ সেই নাম্বারে কল লাগায়। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে একটা মিহি কণ্ঠ ভেসে আসে।
-------হ্যালো আসসালামু ওয়ালাইকুম।
-------ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি প্রায়াণ নিশুতি।
নিশুতি অবাক হয়। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
------আপনি?
-------হ্যাঁ আমি।
-------কেন ফোন করেছেন? আই মিন কোনো দরকার??
এবার প্রায়াণ কি বলবে ভেবে পায় না। সে তো কোনো দরকারে ফোন করে নি।
প্রায়াণ কে চুপ করে থাকতে দেখে নিশুতি বলে,
--------হ্যালো...প্রায়াণ ভাইয়া।
প্রায়াণ আমতা আমতা করে বলে,
--------ফোন দিয়েছিলাম স্নুপির জন্য। আসলে আমি তো ভার্সিটিতে। ও কেমন আছে,খেলো কিনা,তুমি খোঁজ নিয়েছো কিনা এসব জানার জন্যেই কল দেওয়া।
নিশুতি বিনীত গলায় বলে,
-------আপনি স্নুপিকে নিয়ে এত চিন্তা করেন ভাইয়া! আ'ম ইমপ্রেসড।
প্রায়াণ মুচকি হাসে।
নিশুতি বলে,
-------আমি গিয়েছিলাম আপনাদের বাসায়। আমি দেখেছি স্নুপিকে। ও ঠিক আছে। দুপুরে আমি ওকে খাইয়ে দিয়ে আসছি। মেবি এখন ও ঘুমোচ্ছে।
--------ওহ!
--------হুম ভাইয়া। তাহলে রাখছি এখন?
-------নিশুতি।
-------জ্বি।
--------একটা কথা বলি?
-------হুম।
--------মাইন্ড করবা না তো?
--------নাহ। বলুন।
--------তুমি খুব ভালো রঙ চা বানাও।
নিশুতি মিষ্টি করে হাসে।
বলে,
--------আজকে সন্ধ্যায় আবার বানিয়ে খাওয়াবো। আসবেন না সন্ধ্যার আগে বাসায়?
প্রায়াণ উল্লাসিত হয়ে বলে,
--------এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি। জলদিই চলে আসবো।
নিশুতি হেসে ফেলে।
--------আচ্ছা রাখছি।
--------আচ্ছা।
নিশুতি ফোন রেখে দেয়। প্রায়াণ বুকের উপর হাত রাখে তার। হৃদযন্ত্র টা এত জোরে জোরে ঢিপঢিপ করছে কেন!
.
.
-------আম্মুউউউউউউ এটা কি বলতাছো তুমি?
প্রায়াণের চেঁচামেচি দেখে মিনু শেখ খুন্তি নিয়ে আসে। বলে,
--------আরেকবার চেঁচাবি তাহলে এই খুন্তি তোর মুখে ঢুকাই দিবো। ফাও কামে চিল্লাস ক্যান?
প্রায়াণ বিছানার একদম কর্ণারে সরে বসে বলে,
-------আম্মু একটু শুনো আমার কথা টা। নিশুতি কত ছোট আর ভাইয়া কত বড়! আর তুমি কিনা ভাইয়ার সাথে নিশুতির বিয়ে দিতে চাচ্ছো?
-------তো? আমার ডিসিশনই ঠিক। তোর বাপকেও বলেছি। সেও রাজী। এবার শুধু নিশুতি রাজী হলেই হয়। ওর আম্মু আব্বু কে আমি মানিয়ে নিতে পারবো। ও রাজী হলেই আমি বিয়ের সব বন্দোবস্ত করে ফেলবো।
প্রায়াণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে যেন। বুক টা ছ্যাৎ করে উঠে তার। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। তার ভালোবাসা কীনা হতে যাচ্ছে তার ভাবী!! ওহ নো...
প্রায়াণ প্রেমা পিউ'র দিকে অসহায় চোখে তাকায়। প্রেমা তো আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিল প্রায়াণের সাথে নিশুতির কিছু। আজ সিউর হয়ে গেলো। প্রায়াণের চোখে স্পষ্ট নিশুতির জন্য ভালোবাসা দেখা যাচ্ছে।
পিউ বলে,
-------ভাইয়া সমস্যা কী তোমার? নিশুতি আপু এই ঘরের বউ হয়ে আসলে তোমার কী প্রবলেম বুঝলাম না!!
প্রায়াণ দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে,
--------তোর বুঝা লাগবে না।
পিউ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে। প্রেমা মুখ টিপে টিপে হাসে।
প্রায়াণ মনে মনে বলে,
------সরি আম্মু। তোমার দুর্বল সাইডে এবার আমাকে আঘাত করতেই হবে। নয়তো আমার নিশুতি আমার বউ হওয়ার জায়গায় ভাবী হয়ে যাবে। ওহ আল্লাহ!! দড়ি ফালাও। দড়ি ফালাও...
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)