রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ২)


সকাল সকাল চেঁচামেচির শব্দে প্রায়াণের ঘুম ভেঙে যায়। ভার্সিটি না থাকলে সে সচরাচর সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে উঠে না। তার উপর এখন শীতকাল। এখন তো সকাল সকাল উঠার মানেই হয়না। বোমা মেরেও কেউ প্রায়াণ কে সকাল বেলায় উঠাতে পারবে না। অথচ,এখন নিজে থেকেই উঠতে হচ্ছে!!
প্রায়াণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে। চওড়া গলায় ডাকে প্রেমা কে।
------------প্রেমা....প্রেমা....এই কুত্তি...!!
প্রেমা চা বানাচ্ছিল। খুন্তি নিয়ে প্রায়াণের রুমে ঢোকে।
---------সমস্যা কী তোমার ভাইয়া!! আর আমি কুত্তি? তবে তুমি কি?
প্রায়াণ ভাব নিয়ে বলে,
----------আমি ভালো মানুষ।
----------ওরে! আসছে আমার ভালো মানুষ! তোমার মতো বদ দুনিয়াতে আর একটাও নাই।
প্রায়াণ চোখ গরম করে বলে,
----------বেশি প্যাচাল পারিস না। খাবি কানের তলায় দুইটা।
তোরে যে কামে ডাকছি,সেইটা শোন।
প্রেমা বিরক্তির গলায় বলে,
----------কী?
-----------চেঁচামেচি করতেছে কে এই সাত সকালে?
নিশুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-----------আর কোথা থেকে হবে! নিশুতিদের বাসায় হচ্ছে। মনে হচ্ছে,মেয়েটাকে মারছে ওর ডাইনি মা!!
প্রায়াণ কপাল কুঁচকে বলে,
----------সিউর তুই?
----------হুম। ঐ ঘর থেকেই তো শব্দ আসছে চিল্লাচিল্লির।
প্রায়াণ গম্ভীরমুখে বলে,
-----------ওহ।
প্রেমা চলে যায়। চায়ের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে তার। প্রায়াণ বিছানার উপরেই বসে থাকে থম মেরে। ক্ষমতা থাকলে এক্ষুনি একবার যেত সে নিশুতিদের বাসায়। তারপর ওর মাকে যে কি করতো....!! প্রায়াণ মনে মনে বিশ্রি গালি দেয় নিশুতির সৎ মাকে।
.
প্রায়াণ ফ্রেশ হয়ে রুম আসতেই শোনে চিল্লাচিল্লি আরো বেশি বেড়ে গেছে। এবার নিশুতির গলাও শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট।
প্রায়াণ আর থাকতে পারে না। দরজা খুলে তাদের বাসার। প্রায়াণ দের বাসার পাশের ফ্লাট টাই নিশুতিদের। প্রায়াণ ভাবে একবার কলিংবেল দিক। আবার ভাবে,তাতে ওর মা নিশুতিকে সন্দেহ করতে পারে,ব্যাপার আরো বিগড়ে যেতে পারে।
প্রায়াণ কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না কোনো। কিভাবে নিশুতিকে ঐ জাহান্নাম থেকে বের করা যায় সেটিই চিন্তা করছে বারবার।
.
প্রায়াণের মনের চিন্তা দূর করে দেয় মিনু শেখ। প্রায়াণ কে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে,
----------আব্বাজান,এখানে দাঁড়িয়ে আছো ক্যান? কোনো সমস্যা আব্বাজান?
প্রায়াণ ভাবে সে না যেতে পারে,তার মাকে তো পাঠাতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
প্রায়াণ বলে,
--------আম্মু এই বাসা থেকে অনেক চিল্লাচিল্লির শব্দ আসতেছে। দেখো না, কি হইছে ভিতরে।
মিনু শেখ সকাল থেকেই শুনতেছেন শব্দ। তবুও এতক্ষণ চুপ ছিলেন। কিন্তু এখন নিজের ছেলে বলায় আর চুপ করে থাকতে পারেন না।
নাক মুখ কুঁচকে নিচু গলায় বলে,
--------ইফতির মা একটা ডাইনি রে বাবা। সৎ মা হলেও এত অত্যাচার করতে হয় বুঝি!! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দু এক কথা শুনিয়ে দেই ঐ মহিলা কে। আবার ভাবি থাক,আমার এত কিসের ঠ্যাকা!!
প্রায়াণ বিরক্তির গলায় বলে,
-------এসব কথা বাদ দিয়া এখন যাও না মা। দেখো না কি হইছে!!
মিনু শেখ কপাল কুঁচকে ছেলের দিকে তাকান। নিশুতির জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছে কেন প্রায়াণ! কিছু কিছু বুঝলেও প্রকাশ করেন না তিনি। স্বাভাবিক গলায় বলে,
-------যাচ্ছি।
.
নিশুতিদের বাসার কলিংবেল বাজতেই ইফতি দরজা খুলে দেয়। মিনু শেখ কে দেখে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
-------আন্টি আমার বোন কে বাঁচান। আম্মু ওকে মেরেই ফেলবে আজ নয়তো।
মিনু শেখ দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোকেন। গিয়ে দেখেন বিছানার এক কোণায় চুপ করে বসে আছে নিশুতি। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার। আর তার সৎ মা শারমিন হোসেন শলার ঝাড়ু দিয়ে প্রহার করে যাচ্ছে তাকে। বাম হাতের বাহুতে কয়েকটা শলা ঢুকে গেছে ইতিমধ্যে। বেশ কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। রক্তারক্তি অবস্থা....
মিনু শেখ আৎকে উঠেন। শারমিন হোসেন এর হাত থেকে শলার ঝাড়ু কেড়ে নেন তিনি। বাজখাঁই গলায় বলেন,
--------পাগল টাগল হয়েছে গেছেন নাকি ভাবী?? মারতেছেন ক্যান মেয়েটারে এমনে?? মইরা গেলে??
শারমিন হোসেন রাগী গলায় বলেন,
-------মরলে মরুক। মরলেও তো বাইচা যাই। এই ছেড়ি টারে আর সহ্য করবার পারি না আমি।
মিনু শেখ নিশুতির হাত ধরে তাকে টেনে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসে। নিশুতির বাসায় থাকলে এখন শারমিন তাকে আরো মারবে নির্ঘাত।
পেছন পেছন ইফতিও আসে।
নিশুতিকে সোফায় বসান মিনু। পিউ কে বলে ব্যান্ডেএইজ বক্স নিয়ে আসতে। কিন্তু পিউ নিয়ে আসার আগে প্রায়াণই ব্যান্ডএইজ বক্স নিয়ে রুমে ঢোকে। নিশুতির পাশে বসে সে।
হাতের বেশ কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে। প্রায়াণ তুলোর মাথায় কফিসল্ট লাগিয়ে নিশুতির হাতের কাটা জায়গা গুলোয় আলতো করে চেঁপে ধরে এক এক করে। নিশুতি কেঁপে কেঁপে উঠে। ভীষণ জ্বলে যাচ্ছে তার।
নিচু গলায় বলে,
-------প্রায়াণ ভাইয়া,আর দিও না। জ্বলছে খুব।
প্রায়াণ নিশুতির মুখের দিকে তাকায়। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে তার। কালকেও মেয়েটার মুখে হাসি জড়ানো ছিল! আর আজ!!
প্রায়াণ চোখ সরিয়ে নেয় নিশুতির থেকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না ওর দিকে। রাগ বাড়ছে নিশুতির সৎ মায়ের উপর...
প্রায়াণ ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
--------মেরেছে কেন??
ইফতি কান্না থামিয়ে বলে,
--------স্নুপি কে নাকি মুরগির পিস খাওয়াইছে বোন। আম্মু নাকি মুরগির পিস রাখছিল কিছু নিজের জন্য। সেসব নাকি বোন স্নুপি কে খাওয়াইছে। আর তাই...বোন কে...
ইফতি কেঁদে ফেলে।
নিশুতি নতজানু হয়ে নিচু গলায় বলে,
-------আপনি তো কালকে ছাদেই ছিলেন। আমি কি স্নুপিকে কোনো মাংসের টুকরো দিয়েছিলাম ভাইয়া??
প্রায়াণ মাথা নেড়ে বলে,
--------তুমি কিছু ঝুট ভাত আর তরকারি দিয়েছিলা। আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম নিশুতি।
নিশুতি মুখ গোমড়া করে করে বলে,
-------কিন্তু আম্মু বিশ্বাসই করতেছে না।
নিশুতি আঙুল দিয়ে চোখের তলা মুছে।
মিনু শেখ ছেলের উদ্দেশ্যে বলে,
--------তুই আর নিশুতি কাল ছাদে ছিলি? রাতে??
--------হ্যাঁ মা। তবে আমি আগে গিয়েছিলাম। এমনিতেই হাটাহাটি করতে আর নিশুতি ওর পোষা কুকুর কে খাওয়াতে গিয়েছিল। তখনি দেখা হইছে ওর সাথে আমার।
--------ওহ।
ইফতি নিশুতির হাত দুটো ধরে বলে,
--------তোর দোষ না থাকা সত্ত্বেও কত কষ্ট পেলি! বাবা আসুক এবার। আমি বিচার দিবো আম্মুর নামে আপু।
নিশুতি কৃতজ্ঞতার চোখে ইফতির দিকে তাকায়। ইফতি না থাকলে সে এতদিনে হয়তো মরেই যেতো....
আল্লাহর কাছে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে নিশুতি এরকম একটা ভাই দেওয়ার জন্য।
ইফতি মিনু শেখ কে উদ্দেশ্য করে বলে-
--------আন্টি,আপনাদের বাসায় আপুনি থাকুক কিছুক্ষণ। আম্মুর রাগ ঠান্ডা হলে আমি এসে আপুকে নিয়ে যাবোনি?
মিনু শেখ ইফতির মাথায় হাত রেখে বলেন,
-------বয়সে নিশুতির ছোট হলেও কথা আচরণে নিশুতির থেকেও অনেক বড় লাগে তোমাকে। তোমার বোন যতক্ষণ ইচ্ছে আমার বাসায় থাকুক,কোনো সমস্যা নেই।
ইফতি খুশি হয়। প্রায়াণ দের বাসা থেকে বের হয়ে যায়। নিশুতি মুখ ভার করে বসে থাকে। পিউ এসে নিশুতির হাত দুটো ধরে বলে,
-------আপুনি,এত আপসেট হয়ে থাকলে চলে? সব ঠিক হয়ে যাবো। আমাকে একটু পড়াবা? আমার না আজকে কোচিং এ পরীক্ষা।
নিশুতি চোখ মুখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
--------অবশ্যই পড়াবো। বই খাতা নিয়ে এসো যাও।
প্রায়াণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে নিশুতির দিকে। মেয়েটার দুঃখ ভুলে হাসতে টাইম লাগে না!!
.
.
দুপুরের দিকে নিশুতি ছাদে উঠে। সকাল থেকে একবারও ছাদে যায়নি সে। নিশ্চয়ই স্নুপির ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। নিশুতি তার ভাগের কিছু ঝোল মাখানো ভাত নিয়ে এসেছে স্নুপির জন্য। স্টোর রুমে যেতেই অবাক হয় সে।
অবাক হয়ে বলে,
--------প্রায়াণ ভাইয়া আপনি!!
প্রায়াণ নিশুতিকে দেখে মুচকি হাসে। বলে,
--------তুমি তো স্নুপির খবর নাও নি সকাল থেকে। বেচারার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তাই আমিই আসলাম। দেখো কিভাবে গপ গপ করে খাচ্ছে।
নিশুতি নিচু হয়ে বসে। স্নুপি ফ্রাই মাংসের টুকরো গুলো ছিড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। নিশুতি মৃদু হেসে নিজে হাত দিয়ে মাংসের টুকরো গুলো ছিড়ে স্নুপির মুখের দিকে এগিয়ে দেয়। স্নুপি টুপ করে খেয়ে নেয়।
স্নুপির খাওয়া শেষে তাকে আবার তার ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় নিশুতি। স্নুপির পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় কতক্ষণ। তারপর স্টোর রুম থেকে বের হয়ে আসে। প্রায়াণের দিকে ফিরে বলে,
--------থ্যাংকস ভাইয়া।
প্রায়াণ স্মিত হেসে বলে,
--------স্নুপি কে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,একটা কথা বলবো নিশুতি?
নিশুতি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। প্রায়াণ বলে,
--------এখন তো খুব ঠান্ডা পড়েছে। সামনে আরো ঠান্ডা পড়বে। এই ঠান্ডায় স্নুপিকে এভাবে ছাদে রাখা ঠিক না। বাচ্চা কুকুর ও। যদি ঠান্ডা লেগে যায় তখন?? তাই তুমি যদি কিছু মনে না করো,আমি আমার বাসায় স্নুপিকে নিয়ে রাখতে পারি??তোমার যখন ইচ্ছে আমার বাসায় এসে স্নুপিকে দেখে যাইয়ো। আর ওকে খাওয়ানোর দায়িত্বটাও আমাকেই দাও। যদি তুমি চাও আর কী!
নিশুতি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে। লোকটা এত ভালো কেন!!
নিশুতি আবেগী হয়ে বলে,
-------অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাইয়া। সত্যিই আমাকে কিছুটা চিন্তা মুক্ত করলেন। স্নুপিকে নিয়ে আমিও ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। আবার কেউ ওকে চুরি করেও নিয়ে যেতে পারে এখান থেকে।
--------এর মানে তুমি রাজী?
নিশুতি মিষ্টি করে হেসে বলে,
-------রাজী।
প্রায়াণ বিরবির করে বলে,
--------এত হেসো না মেয়ে।।ডায়াবেটিস হয়ে যাবে আমার।
নিশুতি ঠিক শুনতে পায় না। বলে,
-------কিছু বললেন ভাইয়া?
-------না না কিছু না।
--------আচ্ছা ভাইয়া আসি আমি। বাসায় কাজ আছে।
প্রায়াণ কিছু সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
-------আচ্ছা যাও।
নিশুতি চলে যায়। প্রায়াণ ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে,
---------নিশুতি,যদি সম্ভন হয়,একদিন তোমার সব কষ্ট আমি কমিয়ে দিবো। পাক্কা....
কিছুক্ষণ ছাদে থেকেই সিড়ির দিকে পা বাড়ায় প্রায়াণ। আজকেই স্নুপিকে নিজের বাসায় নিবে সে। সেই ব্যবস্থা করতে হবে তাকে...
চলবে......

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)