ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১৭)
ইরফানের সাথে ভুল পথে পা বাড়ানোর পর নিয়ন্তা সবসময় হতাশায় ভুগতো।
এদিকে বর্ণ তার মুখে এক চিলতে হাসি দেখার জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো।
শ্রীমঙ্গল থেকে আসার পর নিয়ন্তার কেনো যেনো বর্ণকে সব সত্যি বলতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু ইরফান বারবার ফোন করার কারণে সেই রাতের ঘটনা নিয়ন্তা এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারতো না।
.
এক দুপুরে হঠাৎ করেই বর্ণকে সব সত্যি জানিয়ে দিলো নিয়ন্তা।
বর্ণ তার কথা শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেও পরমুহূর্তেই মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো-
ভালোবাসো ইরফান কে?
-হু।
-বাসো তো? নাকি ভুল করেছো বলেই যেতে চাইছো তার কাছে?
-বাসি।
-ঠিক আছে। তোমাকে ডির্ভোস দিবো আমি।
-আমি একটু মৌলভীবাজার যেতে পারি?
-ইরফানের বাসায়?
-হু। ওর ফোনটা বন্ধ। আমার সাথে রাগ করেই বন্ধ রেখেছে। আজ ইরফানের জন্মদিনও...
-তুমি নিজে গিয়ে ডিভোর্সের কথা বললে জন্মদিনের সেরা উপহারটি সে পাবে। তাইনা?
.
বর্ণের কথা শুনে মাথাটা নিচু করে রাখলো নিয়ন্তা।
মৃদু হেসে বর্ণ বললো-
আমি নিয়ে যাই তোমাকে?
-ঠিক আছে।
.
.
গাড়ি থেকে নেমে নিয়ন্তা অবাক চোখে ইরফানের বাড়ি দেখতে থাকলো। জমকালো ভাবে সাজানো হয়েছে বাড়িটি। মনে হচ্ছে কোনো বিয়ে বাড়ি।
.
নিয়ন্তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ণ বললো-
কি হলো? ভেতরে যাও। আমি এখানেই আছি।
.
বর্ণের কথা শুনে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো নিয়ন্তা।
.
.
ঠিক ২মিনিট পরেই নিয়ন্তাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখবে ভাবেনি বর্ণ।
নিয়ন্তা এসেই গাড়ির ভেতরে এসে বসে বললো-
গাড়ি চালাও। বাড়ি যাবো আমি।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে বর্ণ জিজ্ঞাসা করলো-
কেনো? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
.
নিয়ন্তার কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে বর্ণ গাড়ি চালাতে মন স্থির করলো। ঠিক তখনি নিয়ন্তা বলে উঠলো-
ভেতরে ইরফানের আন্টি বদল হচ্ছে। তার বাবা সবার উদ্দেশ্যে বললো, আর ৭দিন পরেই ইরফানের বিয়ে। তাই আজকের মতো শুভ দিনে আন্টি বদলের কাজটা সেরে ফেললো তারা।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে বর্ণের মাথায় যেনো রক্ত উঠে যায়। রাগে, ক্ষোভে সে বলে উঠলো-
তুমি বসো, আমি ওই ইরফান কে দেখে নিচ্ছি।
.
বর্ণের হাত ধরে বিনয়ী স্বরে নিয়ন্তা বললো-
কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাড়ি যাবো প্লিজ।
-কিন্তু....
-প্লিজ?
-হুম।
-মায়ের কাছে যাবো আমি।
-ঠিক আছে।
.
.
রাত ১০টা...
সবাই রাতের খাবার খেলেও নিয়ন্তা মুখে কিছু তুলেনি।
নিয়ন্তার পরিবার তার কি হয়েছে বুঝতে না পারলেও বর্ণ ঠিকই বুঝেছে। সে একটা প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ন্তার রুমের দিকে এগুতে থাকে।
তা দেখে পারভীন কবিরের উদ্দেশ্যে রিজাউল কবির বললেন, দেখেছো বর্ণ ছেলেটা কতো ভালো?
- তাই তো দেখছি!
.
নিয়ন্তার দরজার পাশে এসে বর্ণ বললো-
আসবো?
.
চোখ জোড়া মুছে নিয়ন্তা বললো-
হু।
.
নিয়ন্তা পা টেনে মেঝেতে বসে ছিলো। তার পাশে এসে বর্ণও বসলো। হাতে থাকা প্লেট টা মেঝের উপরে রেখে বললো, ভাতের সাথে রাগ করে লাভ কি?
পেট টাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? এমনিতেই একটুখানি একটা পেট, কিছু যদি না পরে তাতে সারারাত কষ্ট পাবে।
.
বর্ণের কথা শুনে মৃদু হেসে নিয়ন্তা বললো-
আমার আসলে ক্ষিদে নেই।
.
প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা ভাত নিয়ে নিয়ন্তার মুখের দিকে এগিয়ে বর্ণ বললো, তা বললে হবেনা। একটু খানি হলেও খেতে হবে।
.
বর্ণের কথা শুনে ভাত মুখে দিলো নিয়ন্তা।
পরমুহূর্তেই সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলে বর্ণ তাকে নিজের বুকে টেনে এনে বললো-
কি হয়েছে পাগলি? ইরফান ধোঁকা দিয়েছে তাতে কি হয়েছে? আমি আছিনা?
-আমার সবকিছু ইরফানকে সঁপে দিয়েছিলাম।
-ইচ্ছে করে নইতো।
-যেভাবে হোক।
-তাই বলে এতো কিছুর পরেও তুমি ইরফানকে নিজের করে চাও? যদি তাই হয় বলো আমাকে, আমি ওকে মেরে মেরে তোমার সামনে নিয়ে আসবো। বাধ্য করবো তোমার সাথেই সংসার করতে।
.
বর্ণের বুক থেকে মুখ তুলে নিয়ন্তা বললো-
আমি ইরফান কে চাইনা। কিন্তু আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাই।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে বর্ণ প্রশ্ন করলো-
কেনো!?
-তুমি ভালো মেয়ে পাবে।
-সেটা আমি জানি। কিন্তু নিমপাতা তো পাবোনা। আর আমি নিমপাতাই চাই। থাকবে না বলো আমার সাথে?
.
.
.
আগের স্মৃতিচারণ করে নিয়ন্তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো।
যে ইরফান তাকে পদে পদে ধোঁকা দিয়েছিলো সেই ইরফান তাকে ভালোবাসবে এটা কিভাবে বিশ্বাস করতে পারলো সে!
কিন্তু তারই বা কি করার ছিলো! বর্ণ যে ইরাকে মেরে ফেলেছে আর তাই....
নাহ আর ভাবতে পারছেনা নিয়ন্তা। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে।
.
.
সদর দরজা খোলা পেয়ে সোজা বাসায় ঢুকে নিজের রুমে আসলো ইরফান।
নিয়ন্তাকে বিছানার উপরে শুধুমাত্র ব্লাউজ আর পেটিকোট পরিহিত দেখে তার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।
গলার স্বর গম্ভীর করে নিয়ন্তার উদ্দেশ্যে বললো সে-
দরজাটা খুলে এসব পরে শুয়ে রয়েছ তুমি! কেউ ঢুকে পড়লে কি করতে?
.
শোয়া থেকে উঠে শান্ত গলায় নিয়ন্তা বললো-
ক্ষতি করে দিতো আমার? আর কি ক্ষতি হতে পারে আমার বলতে পারো?
-তোমার কথা বুঝলাম না আমি।
-বুঝবেনা তো!
.
কিছুক্ষণ নিয়ন্তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর ইরফান প্রশ্ন করলো-
কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেনো তুমি?
.
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে নিয়ন্তা বললো-
যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে আমি আর কিছু বুঝাতে পারবো না।
-মানে?
.
ইরাফানের কাছে এসে নিয়ন্তা বললো-
তোমার সাথে যে মেয়েটার আন্টি বদল হয়েছিলো তার সাথে কি তোমার কথা হয় এখনো?
-তার সাথে কেনো আমার কথা হবে! কি হয়েছে তোমার?
.
দরজার দিকে এগুতে এগুতে নিয়ন্তা বললো-
কিছুনা।
.
.
-আমি মানছি শুরুতে আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু পরে আমি শুধু তোমাই ভালোবেসেছি নিয়ন্তা। সেদিন যখন আমার জন্মদিনের দিন তুমি আমার বাসায় এসেছিলে, আমায় অন্য একটি মেয়েকে রিং পরাতে দেখেছিলে তুমি। এটা যেমন সত্য তার চেয়ে বড় সত্য হলো আমি এসব বিষয়ে কিছু জানতাম না। বাবা হঠাৎ করেই তার বিজনেস পার্টনার এর মেয়ের সাথে আন্টি বদল করে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। অনেক মানুষ থাকাই বাবার মুখের উপর কিছু না বললেও এই বিয়েটা আমি করতাম না। কিন্তু তুমি যে এসেছিলে এটাও আমি জানতাম না। জানলে তোমায় খালি হাতে ফিরিয়ে দিতাম না।
তুমি তো আমাকে ভুল বুঝে ওই বর্ণের সাথে সংসারে মন দিয়েছিলে। কিন্তু আমি ঠিকই বিয়েটা করিনি। তোমার জন্যই অপেক্ষা করেছি নিয়ন্তা। যার ফলস্বরূপ তোমাকে নিজের করে পেয়েছি।
.
কথাগুলো নিজের মনে বলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো ইরফান।
সাথে সাথেই তার ফোনটা বেজে উঠলে রিসিভ করে বললো সে-
হ্যালো বল দোস্ত?
-তোর ঘড়িটা আমার কাছে রয়ে গেলো তো।
-ওহ আচ্ছা। পরে নিবো।
-আজ অনেকদিন পর তোর সাথে শ্রীমঙ্গল ঘুরে ভালোই লেগেছে।
-হুম আমারো ভালো লেগেছে।
-তোকে বললাম সবাই মিলে রাতের খাবারটাও কোথাও সেরে ফেলি। কিন্তু তুই ভাবীর জন্য চলে গেলি।
-অনেকক্ষণ বাসায় একা সে, তাই। বাকিরা কই সব?
-আছে।
-আচ্ছা তোরা মজা কর। আমি রাখি এখন।
-ঠিক আছে।
.
সারাদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরাফেরা করে অনেকটা ক্লান্ত লাগছে ইরফানের।
বিছানার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো সে।
চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো ইরফান।
.
.
.
সকাল ৮টা....
কলিং বেল এর শব্দ পেতেই দরজা খুলে দিলো জয়া।
দরজা খুলে নিয়ন্তাকে দেখতে পেয়ে চমকে গেলো সে।
অবাক চোখে তাকিয়েই সে বললো-
আপনি!
-হুম আমি।
-ভেতরে আসুন।
.
ভেতরে এসে সোফার উপরে বসতে বসতে জয়ার উদ্দেশ্য নিয়ন্তা বললো-
প্রিয়াকে চিনেন কি?
-হুম। প্রতিবেশী তো।
-কতটুকু জানেন তার সম্পর্কে?
.
জয়া হেসে বললো-
আপনি কি জানতে চান বলুন?
-প্রিয়ার স্বামী কোথায়?
-আজ থেকে প্রায় এক মাস আগে প্রিয়ার স্বামী একটা এক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করে।
.
জয়ার মুখে এমন একটা কথা শুনে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো নিয়ন্তা।
কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে সে প্রশ্ন করলো-
তার নাম?
-বাবলু।
.
(চলবে)
Comments
Post a Comment