ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ৮)
নিয়ন্তাকে সারা বাড়ি খুঁজে না পেয়ে ছাদে গিয়েছিলো ইরফান।
সেখানে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়ে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে আসে সে।
.
.
বিছানার উপরে শুয়ে আছে নিয়ন্তা।
একটু আগেই তার জ্ঞান ফিরলো।
কিন্তু ইরফান তার কাছে একটুও আসেনি। তাই মনটা খারাপ হয়ে আছে তার।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে ইরফানের উদ্দেশ্যে বললো-
আমি ইরাকে নিষেধ করেছি। সে আর তোমায় দেখা দিবেনা বলেছে।
.
চুপচাপ সোফার উপরে বসে আছে ইরফান।
শোয়া থেকে উঠে ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে আসলো নিয়ন্তা।
তার পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে বললো-
ইরা আমাদের অংশ। তুমি তাকে দেখতে পেয়ে খুশি হওনি?
.
ইরফান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো-
বিষয় সেটা নয়।
-কি?
-ইরার আত্না আমাদের দেখা দিচ্ছে, এটা কি স্বাভাবিক বিষয়?
-ও আমাদের মেয়ে ইরফান! কেনো স্বাভাবিক নয় বলো?
-সবার ক্ষেত্রেই এটা কি হয়? হয়নাতো।
-সবার ভাগ্য খারাপ তাই হয়না কিন্তু আমাদের ভাগ্য সবার থেকে আলাদা। এতে তোমার খুশি হওয়ার কথা।
-হু।
-আমি ইরাকে বলেছি, তোমায় বিরক্ত না করতে।
.
নিয়ন্তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো ইরফান।
শান্ত গলায় বললো-
তুমি অজ্ঞান কেনো হয়ে গিয়েছিলে?
-ইরা ছাদের রেলিং থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলো। এতো দুষ্টু হয়েছে মেয়েটা। তারপর আমি ওর দিকে এগুচ্ছিলাম আর ঠিক তখনি....
-কি?
-কিছুনা।
.
ইরফানের বুকে মাথাটা গুজলো নিয়ন্তা। ইরফান খালি গায়েই বসে ছিলো।
নিয়ন্তা তার বুকের উপর আলতো করে ঠোঁটটা ছুইয়ে দিতেই ইরফান মুচকি হেসে বললো-
ভুত মেয়ের জন্য আমাকে পটানোর ধান্দা করছো তাইনা?
.
ইরফানের কথাটি শুনেই নিয়ন্তা তার বুকের উপর কামড় বসিয়ে দিলো।
ইরফান মুখে শব্দ করে বলে উঠলো-
এটা কি হলো?
.
ইরফানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তার নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে নিয়ন্তা বললো-
পটাচ্ছি বলেছো তাই আদর ফিরিয়ে নিলাম কামড় দিয়ে।
.
নিয়ন্তার নিচের ঠোঁটে ইরফান হালকা কামড় দিতেই সে লাফিয়ে উঠলো।
ইরফান হাসতে হাসতে বললো-
কেমন নিলাম প্রতিশোধ?
ভ্রু কুচকে নিয়ন্তা বললো-
রান্না করতে যাচ্ছি।
-যেওনা।
-কেনো!
-কামড় দিতে ইচ্ছে করছে আরো।
-আদর খেয়ে রাত পার করা গেলেও কামড খেয়ে করা যাবেনা। আমি গেলাম।
.
নিয়ন্তা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
এদিকে ইরার চিন্তায় ডুব দিলো ইরফান।
ইরা কেনো তাদের দেখা দিচ্ছে?
শুধুমাত্র মায়ের ভালোবাসার জন্য নাকি.....
নাহ।
কিছুতেই ইরার ব্যাপারটা এভাবে হালকা ভাবে নেওয়া যাবেনা।
খুব দ্রুত কিছু একটা করতে হবে।
কিন্তু কি করতে পারে সে?
.
.
.
পেঁয়াজের খোসা ছারাচ্ছে নিয়ন্তা।
রান্না করতে তার একদমই ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু তার যে মন ভালো নেই এটা কিছুতেই ইরফান কে বুঝতে দেওয়া যাবেনা। সে যদি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে তাহলে কি হবে! তাহলে ইরার দেখা পাবে কি করে সে?
ইরার জন্য অনেক কিছুই তাকে সহ্য করতে হবে। দরকার হলে বর্ণ কেও।
আজ ছাদে যখন ইরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো নিয়ন্তা, ঠিক তখনি পেছন থেকে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে।
এই স্পর্শ তার অচেনা নয়। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতেও পারছিলো না।
ঠিক তখনি তার কানে কানে ফিসফিস করে কেউ বললো-
ঠিক ভাবছো নিম পাতা। আমি বর্ণ!
.
এরপর কি হয়েছে কিছুই মনে নেই নিয়ন্তার।
চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো বিছানার উপরে।
.
.
.
ভালোবাসার মানুষটি পাশে থাকলে তার সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছে মনে জাগ্রত হলেই হাজার ঝড়ঝাপটা আসলেও এই ইচ্ছেকে দাবিয়ে রাখতে পারেনা কেউ। সত্যিই ভালোবাসা এক বিচিত্র জিনিস! যার কবলে একবার পড়লে সকল প্রানীই নিজের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলতে বাধ্য।
যেমন ইরফান নিজেই।
এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরে যেখানে তার গভীর চিন্তায় ডুবে থাকার কথা সেখানে নিয়ন্তা পাশে থাকলেই তাকে নিয়ে অন্য এক জগতে পাড়ি জমাতে ইচ্ছে করে তার। নিয়ন্তা পাশে থাকলে দুনিয়া এক দিকে চলে যায় ইরফানের।
কি আছে এই মেয়েটার মাঝে? যে কারণে ইরফান তার জন্য নিজের জানটাও দিতে প্রস্তুত থাকতে পারে!
.
কিন্তু ইরার বিষয়টা সে হালকাভাবে নিতে পারেনা।
নিয়ন্তার কথা অনুযায়ী ইরা কি সত্যিই তাদের কোনো ক্ষতি করবেনা?
.
আপনমনে এসব ভেবে নিজের রুমে পায়চারী করে চলেছে ইরফান।
.
.
.
ঘুমের ঘুমে আচ্ছন্ন আলিনা।
তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে প্রিয়া।
আলিনাকে নিয়ে বড্ড চিন্তায় আছে সে। এই বাড়ি ছেড়ে তার চলে যাওয়া উচিত। একবার অনেক দূরে চলেও গিয়েছিলো। কিন্তু সম্পর্কের টানে সে থাকতে পারেনি দূরে। শুধু সম্পর্ক নয়। ভালোবাসার টানও তাকে এখানে নিয়ে এসেছে আবার।
এতে যে আলিনার ক্ষতি হচ্ছে এটাও সে বুঝছে।
তবে কখনো কখনো জীবনে এমন মোড় চলে আসে, নিজের ক্ষতি হচ্ছে জেনেও ভালোবাসার মানুষটার জন্য অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। তাই তাকেও করতে হচ্ছে।
.
-আম্মু জড়িয়ে ধরো আমায়।
.
আলিনার ডাকে ঘোর কাটে প্রিয়ার। চোখের চশমাটা খুলে বিছানার এক পাশে রাখলো সে।
বিছানায় শুয়ে জড়িয়ে নিলো আলিনাকে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো প্রিয়া।
.
.
.
বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও পড়ছে আর আমি এখানে শুয়ে থাকবো! ইরফানটাও কিভাবে বেঁহুশের মতো ঘুমোচ্ছে!
.
-কি বিড়বিড় করছো নিজে নিজে?
.
ইরফানের গলার আওয়াজ শুনে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিয়ন্তা বললো-
চলোনা বৃষ্টিতে ভিজি?
.
ঘুমঘুম কণ্ঠে ইরফান জিজ্ঞাসা করলো
-বৃষ্টি হচ্ছে?
-হুম, ঝিরিঝিরি।
-এই বৃষ্টিতে ভেজা যায় নাকি!
-যায়না?
-নাহ।
-তবুও যেতে হবে।
-ভালো করে বৃষ্টি পড়লে যাবো।
-ভালো করে কেমন?
-ঝিরিঝিরি নয়, ঝুমঝুম বৃষ্টি।
-কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে, যেমন বৃষ্টিই হোক না কেনো।
-আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি।
-ঠিক আছে।
.
নিয়ন্তা সদর দরজা খুলে উঠানে দাঁড়াতেই বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে শুরু করলো।
নিয়ান্তা খুশি মনে চেঁচিয়ে বললো-
ইরফান? বৃষ্টি বেড়েছে, আসো।
ইর....
.
কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে মুখ চেপে ধরলো নিয়ন্তার।
তার ছোঁয়াতে নিয়ন্তার শরীর একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রইলো নিয়ন্তা। তার কেনো যেনো নড়তে একেবারেই ইচ্ছে করছেনা।
তখনি তার কানে ফিসফিস করে কেউ বললো-
চলে এসেছে তোমার সাহেব।
.
কথাটি বলেই নিয়ন্তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে তাকে নিজের দিকে ঘুরালো সে।
ইরফানকে দেখে নিয়ন্তা বললো-
তুমি এসেছো! আমিতো ভেবেছি এমনিতেই আসবে বলেছো কারণ তোমার বৃষ্টি পছন্দ না।
-বৃষ্টি লীলায় মাততে এসেছি তোমারো সাথে সাথী।
-আমি সাথী ফাতী না। আমি নিয়ন্তা।
.
মুচকি হেসে ইরফান হঠাৎ করেই নিয়ন্তার ঠোঁটে তার ঠোঁট জোড়া ডুবালো। পরম আবেশে ইরফানের চুলগুলো আঁকড়ে ধরলো নিয়ন্তা।
.
ক্ষানিকক্ষণ নিয়ন্তার ঠোঁটের স্বাদ নেওয়ার পর তার কোমর চেপে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে ইরফান বললো-
চুলগুলো ছিড়ে ফেলবে নাকি?
-ঠোঁট গুলো খেয়ে ফেলবে নাকি?
-হুম।
-আমিও হুম।
-তোমার যদি টাকলা জামাই পছন্দ হয় আমি আর কি বলবো!
-তোমার যদি ঠোঁট
ছাড়া বউ দেখতে খারাপ না লাগে আমি কি বল....
.
আর কিছু বলার আগেই নিয়ন্তা কাঁশতে শুরু করলো।
রাগান্বিত কণ্ঠে ইরফান বললো-
শখ মিটলো তো তোমার?
-কিসের?
-বৃষ্টিতে ভেজার।
-উহু! মিটেনি। মাত্রই এলাম।
-আজ তুমি মাইর খাবেই আমার।
-কেনো!
-এখুনি ভেতরে গিয়ে ভেজা কাপড় বদলে নাও।
-আরেকটু...
-নিয়ন্তা, মাইর না খেতে চাইলে যাও বলছি।
-উম্ম... এক শর্তে যাবো।
-কি?
-মাইরের বদলে অন্য কিছু দিতে হবে।
-কি?
-কি! বুঝোনা? ন্যাকামি?
.
এক গাল হাসি নিয়ে ইরফান বললো-
যাবা তুমি!
.
কয়েক পা বাড়িয়ে থেমে গেলো নিয়ন্তা। পেছনে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো-
তুমি কেনো দাঁড়িয়ে আছো?
-দরজা বন্ধ করে আসছি, তুমি যাও।
.
.
ভেজা কাপড় নিয়ে ভেজা শরীরে নিজের রুমে প্রবেশ করে লাইট অন করলো নিয়ন্তা।
কিন্তু বিছানার উপরে ঘুমন্ত অবস্থায় ইরফানকে দেখে চমকে গেলো সে।
ইরফান যদি এখানে হয় তবে তার সাথে বাইরে কে ছিলো!
আর কিছু না ভেবে নিয়ন্তা এগুতে থাকে সদর দরজার দিকে।
.
(চলবে)
Comments
Post a Comment