ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১২)
নিয়ন্তার করা প্রশ্নে জবাব দিলো ইরফান-
এলাকার মেয়ে। প্রতিবেশী।
-ওহ! তোমরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসো আমি তোমাদের জন্য কফি করে আনছি।
-জয়া কফি খায়না। তুমি সবার জন্য চা করো।
-ঠিক আছে।
.
জয়ার সাথে ইরফান বেরিয়ে যেতেই আপনমনে নিয়ন্তা বলতে লাগলো-
প্রতিবেশী চা নাকি কফি খান এটাও উনি জানেন!
.
.
ড্রয়িংরুমে এসে সোফার উপরে বসতে বসতে জয়া বললো-
আমিতো ভেবেছিলাম নিয়ন্তা একটা হুর পরী।
-মানে?
-মানে বুঝোনি?
-নাতো।
-আমার প্রস্তাব তুমি ওর জন্যই অগ্রাহ্য করেছিলে, তাইনা?
-হু।
-তাই ভেবেছি ও আমার চেয়ে অনেক বেশিই সুন্দরী।
-সুন্দর অসুন্দর দিয়ে ভালোবাসা হয়?
-কি দিয়ে হয়?
-সে তুমি বুঝবেনা।
-যেদিন তুমি এখানে এসেছিলে সেদিন থেকেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। তোমার পেছনে সবসময় ঘুরঘুর করতাম। তোমার পাশে থাকতে চাইতাম। তবুও তুমি আমার ভালোবাসা বুঝোনি। বেহায়ার মতো মাকে বলেছিলাম তোমায় বিয়ে করার কথা। যেদিন মা প্রস্তাব নিয়ে আসলেন সেদিনই জানলাম তুমি নিয়ন্তা নামের কোনো এক মেয়েকে ভালোবাসো। তাও আমি আশা ছাড়িনি। এখন তুমি বলছো আমি কিনা ভালোবাসাই বুঝিনা?
-দেখো জয়া....
.
ইরফান কিছু বলার আগেই নিয়ন্তা হাতে ট্রে নিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে আসলো।
চায়ের একটা কাপ হাতে নিয়ে জয়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো-
বাসায় কে কে আছে আপনার?
-মা, বাবা, ৩ভাই আর একটা ছোট বোন।
-ওহ।
-আমার মায়ের সাথে কথা হয়েছিলো আপনার।
-কবে?
-পুকুরপাড়ে। মা আমাকে বলেছে।
-ওহ! উনি তোমার মা!
-হুম।
-উনি বলেছিলেন উনার মেয়ের সাথে ইরফানের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সে মেয়ে কি তুমি?
.
হালকা হেসে জয়া বললো-
হুম।
.
ইরফানের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে নিয়ন্তা বললো-
এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে বিয়ে করলেনা কেনো?
-করে নিবো? ও কিন্তু রাজি আছে এখনো।
.
ইরফানের কথা শুনে হাসি থেমে গেলো নিয়ন্তার।
ভ্রু জোড়া কুচকে জয়ার উদ্দেশ্যে বললো সে-
ইরফান কিন্তু আমারই।
.
.
বেশ খানিকক্ষণ হলো নিয়ন্তা রান্নাঘরে, চুলায় চিংড়ি মাছ বসিয়েছে তাই। ওদিকে ইরফান আর জয়া ড্রয়িংরুমে।
ইরফানের সাথে জয়াকে এভাবে বসিয়ে রাখা কি ঠিক হয়েছে?
হাজার হোক, মেয়েতো!
আপনমনে এসব ভাবতেই ইরার দেখা পেলো নিয়ন্তা।
ইরা দাঁড়িয়ে রয়েছে বেসিনের এক পাশে।
তাকে দেখে এক গাল হেসে নিয়ন্তা বললো-
আমার মা টা কখন এসেছে?
-এখুনি।
-সবসময় আসতে পারোনা ইরা?
-আসতেই দিতে চায়না।
-কার এতো বড় সাহস! কে দিতে চায়না?
.
-কার সাথে কথা বলছেন আপনি?
.
পেছনে তাকিয়ে জয়াকে দেখতে পেয়ে নিয়ন্তা বললো-
নিজে নিজেই।
-নিজে নিজে!
-কথা না, আসলে গুনগুন করে গান গাইছিলাম।
-ওহ!
-কিছু লাগবে?
-আমি চলে যাচ্ছি তাই দেখা করতে আসলাম।
-সে কি! দুপুরের খাবার খেয়ে যান?
-অন্য একদিন।
-ঠিক আছে।
.
ইরার দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তক দেখলো সে ইরাকে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু জয়া দেখতে পাচ্ছেনা। তার মানে ইরা শুধুই তার মা বাবাকে দেখা দিচ্ছে!
এটা ভালোবাসার টান ছাড়া কিছুই নয়।
.
.
জয়াকে এগিয়ে দিতে নিয়ন্তা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে তার পিছপিছু গেলো।
জয়া বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার এলোচুল ঠিক করতে করতে বললো-
তোমরাও একদিন এসো আমাদের বাসায়।
.
মৃদু হেসে ইরফান বললো-
চুলগুলো বাঁধলেই পারো। এতোবার ঠিক করতে হতোনা আর
.
হালকা হেসে জয়া বললো-
একজন বলেছিলো আমায়, এলোকেশেই নাকি আমাকে ভালো দেখাই। তাই....
আচ্ছা আসি।
.
.
জয়া বেরিয়ে যেতেই ইরফানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
নিশ্চয় সেই একজনটা তুমি?
.
আমতাআমতা করে ইরফান বললো-
না মানে, হ্যাঁ আমি বলেছিলাম।
-তাই!
-ওটাতো কথার কথা বলেছি!
.
গাল ফুলিয়ে নিয়ন্তা চলে যেতে চাইলে ইরফান তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।
তার খোপাটা খুলে দিয়ে চুলের ভেতর নাক ডুবিয়ে বললো-
তাকে ভালো লাগে বলেছি। এইরকম কতোকিছুই কতো জনকে বলি। কিন্তু তোমার চুলের গন্ধে নেশা হয়ে যায় যেখানে ডুবে থাকা যায়। এটা জানোনা তুমি?
-হু।
.
নিয়ন্তার চুলগুলো একপাশে সরিয়ে তার ঘাড়ে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতেই রান্নাঘর থেকে থালাবাসন নিচে পড়ার শব্দ পেলো তারা।
ইরফানের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিয়ন্তা বললো-
ইরা ছিলো ওখানে। ওর কিছু হলো কিনা দেখে আসি।
.
.
-ইরা এতো বেশি দুষ্টমি করা ঠিক না মা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে মায়ের রান্না দেখো কেমন?
.
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নিয়ন্তাকে কথা বলতে দেখতে পেলেও ইরাকে দেখতে পেলোনা ইরফান।
তার মানে সে নিয়ন্তার কথা শুনেছে। এটাও কম কিসের!
নিয়ন্তা হয়তো ইরার আত্মা দেখে শান্তি পায় কিন্তু ইরফানের ক্ষেত্রে তার উল্টো হয়। এজন্যই হয়তো অনেকে বলেন, মায়ের ভালোবাসা বাবার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ। যদিও এটা সবাই মানেনা কিন্তু ইরফান মানে। কেননা তার মা কখনো তার খারাপ চায়নি কিন্তু বাবা...
নিয়ন্তার সাথেও যা করতে বলেছিলেন তা একেবারেই অনুচিত ছিলো। নিজের ছেলেকে কেউ বলে, অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে বাইরে ফূর্তি করতে! তার ভালোবাসায় খাদ ছিলো বলেই এসব বলেছে। আর ইরফান! সে নিজে কি করেছে। সেতো....
নাহ, আর ভাবতে পারছেনা সে।
লুকিয়ে একটা সিগারেট টানার খুব প্রয়োজন তার।
.
আপনমনে এসব ভেবে ইরফান এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
.
.
বিকাল ৪টা....
পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিয়ন্তা।
এই জায়গাটায় তার কাছে প্রশান্তির জায়গা মনে হয়।
আর হাটার জায়গা বলতে পুকুরপাড় ছাড়া কিছু খুঁজেই পায়না সে৷ এই হুসাইন পুর গ্রামটা ঘনবসতিপূর্ণ নয়। যার কারণে আশেপাশে তেমন একটা বাড়িঘর দেখাই যায়না।
.
আচমকা বাতাসের গতি বাড়তে থাকলো।
নিয়ন্তা তার চুলগুলো ছেড়ে দিলো। দুহাত ছড়িয়ে এই মুহুর্তটা উপভোগ করতে লাগলো সে।
ঠিক তখনি ইরফান এসে নিয়ন্তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার খুব কাছে টেনে নিলো। নিয়ন্তার কোমর চেপে নাকে নাক লাগিয়ে বলতে থাকলো-
পড়ন্ত বিকেল বেলাই,
চলোনা দুজনে দুজনাতে হারিয়ে যাই।
মুখোমুখি, পাশাপাশি
ঠিক এতোটা কাছাকাছি,
যতোটা হলে তোমার নিঃশ্বাস অনুভব করা যায়!
পড়ন্ত বিকেলের শীতল হাওয়ায়,
যখন তোমার চুল দুলতে থাকে,,
হাওয়ার বেগে যখন তোমার শাড়ির আঁচল উড়তে থাকে,,,
তুমি জানো?
এসব শুধুই মাতাল করে আমাকে।
.
ইরফানের মুখে নিজের প্রশংসা কবিতা আকারে শুনে খানিকটা লজ্জা পেলো নিয়ন্তা।
ইরফানের কাছ থেকে নিজেকে সরাতে চাইলে ইরফান তাকে জোরে চেপে ধরলো। আর ঠিক তখনি গাছে বসে থাকা পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করতে থাকলো।
তা দেখে ইরফান আবারো বললো-
এই মুহুর্তগুলো অতি যত্নে গুছিয়ে রাখবে দুই মন,
পাখিদের দল তাদের সুরে জানিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার অভিনন্দন।
.
নিয়ন্তার গাল ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই সে পুকুরে কিছু একটা ধপাস করে পড়ার শব্দ পেলো।
পুকুর পাড়ে তাকিয়ে দেখলো ইরা ডুবে যাচ্ছে।
ইরফানের উদ্দেশ্যে নিয়ন্তা বললো-
ইরা ডুবে যাচ্ছে ইরফান! ইরা ডুবে যাচ্ছে।
.
পুকুরপাড়ে তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে ইরফান বললো-
কোথায় ইরা!
-তুমি পানিতে নেমে ওকে বাঁচাও।
-নিয়ন্তা তুমি কেনো ভুলে যাও ইরা একটা আত্মা!
-তুমি নামবে নাতো?
-নিয়ন্তা...
-ঠিক আছে। নামতে হবেনা তোমায়।
.
ইরফানের আর কোনো
কথা না শুনে পুকুরে ঝাপ দিলো নিয়ন্তা।
.
ইরফান জানে নিয়ন্তা সাঁতার কাটতে পারেনা। তাই সেও দেরী না করে ঝাপ দিয়ে দিলো।
.
.
সন্ধ্যা ৬টা.....
নিয়ন্তার পাশে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছে ইরফান।
নিয়ন্তা নিজের বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
নিয়ন্তার মায়াবী চেহারার দিকে তাকিয়ে ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
কিছুদিন যাবৎ নিয়ন্তার কাছাকাছি যেতে চাইলেই কিছু না কিছু ঘটছে। এতো কাছে থেকেও দূরত্ব বেড়ে চলেছে তাদের মাঝে।
কেনো?
ইরার আত্মার জন্য? আত্না বললে ভুল হবে, ইরার প্রেতাত্মার জন্য।
এখান থেকে নিয়ে গেলেই কি সব সমাধান হবে? হয়তো না। কেননা ইরার আত্মা এখানে আসতে পারলে সব খানেই যেতে পারবে।
.
আপনমনে এসব ভাবতেই ইরফানের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো জয়ার ফোন।
সচারাচর প্রয়োজন ছাড়া ইরফানকে ফোন দেয়না জয়া। তাহলে আজ কেনো দিচ্ছে?
.
আর না ভেবে ফোন রিসিভ করলো ইরফান।
.
ওপাশ থেকে জয়া কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো-
ইরফান? প্লিজ এখুনি বাসায় আসো।
.
জয়ার গলা শুনে ঘাবড়ে গেলো ইরফান।
জয়ার উদ্দেশ্যে সে প্রশ্ন করলো-
কি হয়েছে?
-আসোনা প্লিজ।
-আচ্ছা আমি আসছি।
.
নিয়ন্তার দিকে তাকাতেই ইরফান দেখতে পেলো সে চোখ খুলেছে।
ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে নিয়ন্তা বললো-
কিছু হয়েছে?
-আমি একটু আসছি। দরজাটা বন্ধ রেখো।
.
ইরফান বেরিয়ে যেতে থাকলো আর তার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো নিয়ন্তা।
নিয়ন্তাকে এই অবস্থায় ফেলে সে এভাবে চলে গেলো ওই জয়ার কাছে! কেনো গেলো সেটাও কি বলে যেতে পারতো না!
.
আপনমনে এসব ভেবে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো নিয়ন্তা।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে সদর দরজার দিকে।
কিন্তু দরজা আটকানোর সময় প্রিয়াকে দেখে চমকে গেলো সে।
-এই সময়ে আপনি?
.
ভেতরে এসে প্রিয়া বললো-
তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।
-কি?
.
প্রিয়া তার হাতে থাকা পেইন্টিং টা নিয়ন্তার দিকে দেখিয়ে বললো-
এই যে এটা।
.
নিয়ন্তা দোলনায় বসে আছে, তার কোলে বসে আছে ইরা।
এমন একটা হাতে আঁকা নিখুঁত ছবি দেখে অবাক হলো নিয়ন্তা।
.
প্রিয়ার হাত থেকে ছবিখানা নিয়ে সে বললো-
দারুণ! আমি আর আমার মেয়ে! আপনার স্বামী একেছে নিশ্চয়?
-হুম।
.
কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকানোর পর নিয়ন্তার মনে পড়লো প্রিয়ার স্বামীর সাথে তার দেখাই হয়নি। আর ইরাকে দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তাহলে এই ছবিটা তিনি কিভাবে একেছেন তাদের না দেখেই!
.
(চলবে)
Comments
Post a Comment