রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ১)


কলিংবেল বাজতেই প্রায়াণ উঠে দরজা খুলে। ছোট্ট ছিপছিপে শ্যামবর্ণের একটা মুখ, চোখভর্তি তার মায়া,মুখে হাসি জড়ানো। মিহি কণ্ঠে বললো,
---------প্রেমা নেই ভাইয়া?
প্রায়াণ মুগ্ধ নয়নে নিশুতির দিকে তাকিয়ে ভেতরের ঘরের দিকে ইশারা করে। নিশুতি কপাল কুঁচকে বলে,
---------আংকেল বাসায়?
প্রায়াণ মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাকায়।
নিশুতি বলে,
----------তাহলে আর ভেতরে যাবো না। এই ট্রে টা ধরুন তো। প্রেমাকে দিয়ে দিবেন।
প্রায়াণ ট্রে টা ধরে। তাতে ৫ কাপ রং চা।
নিশুতি বলে,
---------বড় ভাইয়া তো বাসায় নেই বোধহয় তাই ৫ কাপ দিলাম। আন্টিকে বলবেন,আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ওকে?
প্রায়াণ ঘাড় অব্দি মাথা কাত করে অস্ফুটস্বরে বলে,
----------ওকে।
নিশুতি চোখ বড় বড় করে বলে,
----------আপনি দেখি কথাও বলতে জানেন! আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বোবা!
প্রায়াণ কি জবাব দিবে ভেবে পায় না। প্রায়াণ কে আবার থম মেরে যেতে দেখে নিশুতি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। মানুষকে কনফিউশনে ফেলে দিতে তার ভীষণ ভালো লাগে।
নিশুতি চলে যায়। প্রায়াণ পা দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে যায়।
.
.
জালাল শেখ আর মিনু শেখের ছোট ছেলে প্রায়াণ,বড় ছেলে প্রত্যুষ। আরও দুটি মেয়ে আছে তাদের। বড় মেয়ে প্রেমা,ছোট মেয়ে পিউ। এই চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার।
.
মিনু শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল। প্রায়াণকে আওয়াজ লাগান তিনি।
---------প্রায়ু...কে এসেছে বাবা?
প্রায়াণ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
----------পাশের বাসা থেকে একটা মেয়ে চা দিয়ে গেলো।
পিউ চায়ের কথা শুনে নড়েচড়ে উঠে। চা আবার তার খুব বেশিই প্রিয় কিনা!
উল্লাসিত কণ্ঠে বলে,
----------আমি কিন্তু দুই কাপ খাবো।
প্রেমা মাঝখান দিয়ে বলে,
---------খাইস। এমনিতেও প্রায়াণ ভাইয়া রঙ চা খায় না!!
প্রায়াণ টি-টেবিলের উপর ট্রে রেখে সবার আগে আগে এক কাপ চা তুলে নেয়। প্রেমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
--------আগে খাইনি,এখন খাবো।
মিনু,পিউ,প্রেমা তিনজনই বেশ অবাক হয়। মিনু ভ্রু কুঁচকে বলে-
----------মাইরাও তোকে রঙ চা খাওয়াতে পারিনি কখনো। আর আজকে নিজে থেকেই খাচ্ছিস! ব্যাপার কি আব্বাজান?
প্রায়াণ লজ্জা পায়। মুচকি হেসে সোফার উপর বসে।
জালাল শেখ রুমে ঢোকেন। মিনু বলে,
---------চা খাও। শীতের সন্ধ্যায় রঙ চা খাওয়ার মজাই আলাদা।
.
.
রাতের বেলা সবাই ভাত খাওয়া শেষ করে একসাথে গোল হয়ে বসে বিছানার উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে। প্রত্যুষ ও আছে এবার। কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে এসেছে সে।
আড্ডার টপিক প্রত্যুষের বিয়ে।
মিনু শেখ জালাল শেখের উদ্দেশ্যে বলে,
------------তোমার তো কত বন্ধু আছে। দেখো না,কোথাও একটা ভালো মেয়ে পাও কীনা! মেয়ে বড়লোক ঘরের হতে হবে না। শুধু নামাজ কালাম জানা আর সংসারের সব কাজ জানা হলেই চলবে।
পিউ ফোড়ন কাটে।
----------আর হালকা নাঁচ গান ও জানতে হবে। মাঝে মাঝে বিকেলে আমরা সাউন্ড বক্স ছেড়ে তিনজনে নাঁচবো। কী প্রেমা আপু ঠিক বলছি না?
প্রেমা হাসে। পিউর চুল টেনে বলে,
---------সব কিছুতেই তোর নাঁচ গান!!
মিনু শেখ দুজনকে ধমকে উঠেন।
---------আহ!! চুপ কর তো তোরা!
জালাল শেখ প্রত্যুষের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-----------তোর কেমন মেয়ে পছন্দ?
প্রত্যুষ জবাব দেয় না। তার এই টপিক টা মোটেও ভালো লাগছে না। কী এমন বয়স হয়েছে তার যে এখনি বিয়ে দেওয়ার জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছে!!
প্রত্যুষ চুপ করে আড্ডা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। জালাল শেখ গর্জে উঠেন।
----------দেখলা মিনু!! তোমার ছেলে কখনো বাপের কথা গুরুত্ব দেয় না। কেমনে বেয়াদবের মতো উঠে চলে গেলো।
মিনু শেখ পালটা ধমক দেন জালাল শেখ কে। গরম গলায় বলেন,
----------নিজের বিয়ের কথা শুনতে লজ্জা লাগছিল বোধহয় তাই চলে গেছে। এত ফ্যাচ ফ্যাচ করো ক্যান তুমি??
জালাল শেখ বউয়ের ধমকে ভেজা বিড়াল হয়ে যান। প্রেমা পিউ মুখ টিপে টিপে হাসে।
এতক্ষণ কোনো কথা না বললেও প্রায়াণ এবার বলে,
-----------আব্বু,ভাইয়ের কথা বাদ দাও না। আমার কথা শুনো। আমার কেমন মেয়ে পছন্দ শুনো....
যার গায়ের রঙ থাকবে শ্যামবর্ণ, চোখভর্তি তার মায়া থাকতেই হবে আর মুখ টা যেন হয় হাসি হাসি। এরকম একটা মেয়ে আমি বিয়ে করবো...
প্রেমা কনুই দিয়ে প্রায়াণ কে গুতো মেরে উঠে। প্রায়াণ মায়ের দিকে তাকায়। মিনু শেখ গরম চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। জালাল শেখ গলা খাকারি দিয়ে উঠেন।
---------তোর বিয়ের কথা চলছে নাকি প্রত্যুষের?? যা এখান থেকে....
প্রায়াণ হাসি দিয়ে উঠে পড়ে।রুম থেকে বের হতে বের হতে বলে,
---------আমার কিন্তু এমন মেয়েই চাই। আগে থেকেই বলে রাখলাম।
.
.
.
রাতের বেলা প্রায়াণের রুমে কম্বল দিতে এসে দেখে প্রায়াণ কাগজে কিছু লেখালেখি করছে।
প্রেমা কপাল কুঁচকে বলে,
-----------রাত বাজে ১২ টা!! এখন আবার কি পড়তে বসলা?
প্রায়াণ কাগজের ভেতর মুখ গুঁজেই বলে,
-----------পড়তে বসি নাই। লিখতেছি কিছু। তুই যা।
প্রেমা মুখ ভেংচি কাটে। সেটা প্রায়াণ আদৌও দেখে কীনা কে জানে! কেননা তার নজর কাগজের ভেতরেই নিবদ্ধ।
প্রেমা রুম থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই প্রায়াণ আবার ডেকে উঠে। প্রেমা দাঁড়ায়। প্রায়াণ হাতের ইশারায় তাকে কাছে আসতে বলে।
প্রেমা প্রায়াণের কাছে আসলে প্রায়াণ বলে,
----------পাশের বাসার ঐ মেয়েটার নাম কি রে??
প্রেমা সন্দিহান দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
---------সন্দেহ।
প্রায়াণ নাক মুখ কুঁচকে বলে,
---------সন্দেহ নাম?
---------উহু না রে বাবা। মেয়ের নাম তো নিশুতি.. আমি বললাম,আমি সন্দেহের ঘ্রাণ পাচ্ছি।
প্রায়াণ স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে,
--------নিশুতি! বাহ নাম টা তো দারুণ।
--------হুম। আর মেয়েটাও বেশ দারুণ। কিন্তু কপাল পোড়া।
---------কেন?
প্রেমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
----------মা নেই। সৎ মা বাসায়। ঘরের সমস্ত কাজ মেয়েটাকে করায়। তবুও কত অত্যাচার করে। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই মেয়েটাকে মারধোর করে।
প্রায়াণের হুট করেই রাগ উঠে যায় মাথায়। রাগে তার রগ কাঁপতে থাকে।
প্রায়াণ গম্ভীর গলায় বলে,
---------ওর বাবা নেই?
---------আছে তো। কিন্তু সে তো বউয়ের কথা উঠে,বউয়ের কথায় বসে। মেয়ের দিকে খেয়াল করার সময় আছে নাকি তার!!
প্রায়াণ নিচু গলায় একটা গালি দিয়ে বসে নিশুতির বাবা নামক প্রাণি টাকে।
প্রেমা বলে চলে-
---------তবে একজন আছে ওদের বাসায় যে নিশুতিকে খুব সাপোর্ট করে। ইফতি,নিশুতির ভাই। সৎ ভাই কিন্তু একদম আপন ভাইয়ের মতো নিশুতির চেয়ে ৪ বছরের ছোট সে। তবুও নিশুতিকে খুব সাপোর্ট করে ছেলেটা। এই তো কয়েকদিনের আগের ঘটনা। নিশুতির হাত থেকে ভুল করে একটা কাঁচের গ্লাস পড়ে ভেঙে পড়ে যায়। মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে গেছিল একদম। ঐ ডাইনি মহিলা মেরেই ফেলতো ওকে। পরে ইফতি গ্লাস ভাঙার দায় নিজের উপর নিয়ে নেয় বিধায় নিশুতি মাইর খাওয়া থেকে বেঁচে যায়।
প্রায়াণের শরীর রাগে তিরতির করে কাঁপতে থাকে। তার এত কেন রাগ হচ্ছে সে নিজেও তার কারন খুঁজে পায় না।
প্রেমা কে বলে,
---------মেয়েটা এখানে পড়ে আছে কেন! বিয়ে করে নিয়ে অন্যের ঘরে চলে গেলেই তো পারে। এত কষ্ট সহ্য করা লাগতো না।
প্রেমা মৃদু হেসে বলে,
----------অন্যের ঘরে তো এর থেকেও বেশি অশান্তি থাকতে পারে। তাইনা? যাইহোক,মেয়েটার ডাক্তার হওয়ার খুব শখ। মেধাও ভালো। এস এস সি তে এ প্লাস পেয়েছে।
----------ওহ! এখন কিসে পড়ে?
----------এবার ইন্টার পরীক্ষা দিলো। সামনে রেজাল্ট দিবে। আমি মাঝে মাঝে যাই ওদের বাসায়। তখন অনেক গল্প করি দুজনে।
প্রায়াণ গোমড়া মুখে বললো,
---------ভালো।
প্রেমা হাই তুলতে তুলতে বলে,
---------এবার যাই ভাইয়া? ঘুম পাচ্ছে।
প্রায়াণ নিচু গলায় বলে,
----------যা।
----------গুড নাইট ভাইয়া।
প্রেমা উঠে চলে যায়।
প্রায়াণ চুপ করে বসে থাকে।বারবার নিশুতির মুখ টা ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। মেয়েটা কত যন্ত্রণায় আছে!! অথচ দেখলে মনেই হয় না..!
প্রায়াণ এর বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
.
.
এত রাতে ছাদে কারো অবয়ব দেখে নিশুতি ভয়ে কেঁপে উঠে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
--------কে?? কে ওখানে!!
প্রায়াণ কিছুক্ষণ আগেই এসেছিল ছাদে। সিগারেট খেতে। রাতে ভাত খাওয়ার পর তার একটা সিগারেট না হলে চলে না।
প্রায়াণ ও এভাবে নিশুতিকে এখানে দেখবে, তাও এত রাতে!! কল্পনাতেও ভাবেনি।
প্রায়াণ নিচু গলায় বলে,
--------আমি, প্রায়াণ।
নিশুতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
----------ওহ! প্রেমার ভাই? তা ভাইয়া আপনি এখানে।
প্রায়াণ কোনোমতে বলে,
----------এমনিতেই আসছিলাম। একটু হাটাহাটি করার জন্য!
নিশুতি মুচকি হেসে বলে,
-----------হাটাহাটির জন্য নাকি সিগারেট খাওয়ার জন্য ভাইয়া?
প্রায়াণ থতমত খায়। কেমনে বুঝলো মেয়েটা!!
নিশুতি আবার বলে,
----------আমি বুঝতে পারছি আপনি কেন এসেছেন। যাকগে,সে সব। আপনি ওদিক টায় খান গিয়ে। আমি আবার এসবের গন্ধ সহ্য করতে পারিনা। আর এখন আমার এখানে কাজ আছে।
প্রায়াণ কপাল কুঁচকে বলে,
-----------এত রাতে ছাদে কি কাজ তোমার!
নিশুতি আবারো মুচকি হাসে। প্রায়াণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটার হাসি দেখে।
নিশুতি হাতে তুরি মারতেই ছাদের স্টোর রুমের ভেতর থেকে একটা কুকুর বেরিয়ে আসে। ছোট্ট বাচ্চা কুকুর।
নিশুতি কুকুর টাকে কোলে নিয়ে বলে,
---------৩ মাস আগে থেকেই ওকে পালি আমি। আম্মু বাসায় জায়গা দেয় না তাই ছাদে ঘর করে দিয়েছি ওর। ওখানেই থাকে। আমি আসি প্রতিদিন ওকে,এই সময়টায় খাবার দিতে।
নিশুতি কুকুর টাকে কোল থেকে নিচে নামিয়ে দেয়। কুকুর টাক নিশুতির গা ঘেঁষে দাড়ায়। শীতে কাঁপছে বোধহয়।
নিশুতি পলিথিনে করে নিয়ে আসা ভাত তরকারির অবশিষ্ট একটা ভাঙা প্লেটে বেড়ে দেয়। কুকুর টা গপ গপ করে গিলতে থাকে।
নিশুতি মুগ্ধ নয়নে কুকুর টার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর প্রায়াণ নিশুতির দিকে....
দুজনেই চুপচাপ।
নিরবতা ভাঙে প্রায়াণ।
বলে,
----------নাম কী ওর?
----------স্নুপি।
-----------স্নুপি??
-----------হুম।
------------বাহ! সুন্দর তো।
-----------হুম।
স্নুপির খাওয়া শেষ হয়। নিশুতি একটা চাদর নিয়ে এসেছে সাথে করে। সেটা খুব সুন্দর করে জড়িয়ে দেয় স্নুপির গায়ে। তারপর কোলে করে স্টোর রুমে নিয়ে যায়। স্টোর রুমের ভেতরে এক কোণায় কার্টন, তুলা,আর টুকরো কাপর দিয়ে একটা জায়গা করা। প্রায়াণ ভাবে এটাই বোধহয় স্নুপির ঘর।
নিশুতি সেখানে শুইয়ে দেয় স্নুপিকে। স্নুপি গুটি মেরে শুয়ে থাকে।
নিশুতি নিচু গলায় বলে,
---------গুড নাইট স্নুপি। সকালে দেখা হবে আবার। কেমন?
স্নুপি কী বুঝলো কে জানে! কেউ কেউ করে উঠে দুইবার শুধু। নিশুতি মিষ্টি করে হেসে স্নুপির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।
.
.
স্টোর রুম থেকে বের হয়ে নিশুতি বলে,
---------ভাইয়া এবার আপনি সিগারেট খেতে পারেন। আমি আসি।
ছাদের গেইটের কাছাকাছি অব্দি যেতেই প্রায়াণ ডাকে নিশুতিকে। নিশুতি পেছন ফিরে তাকায়। প্রায়াণ মৃদু হেসে বলে,
--------গুড নাইট।
নিশুতিও মুখে হাসি এঁকে বলে,
--------আপনাকেও।
এরপর চলে যায়। ছাদে একা প্রায়াণ দাঁড়িয়ে রয়। তার আর এখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে নিশুতিকে আবার ডাকতে। নিশুতির সাথে গল্প করতে....
চলবে......

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)