ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১৫)


প্রিয়া কি আসলেই কৌতুহলবশত এসব জানতে এসেছে? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? যদি থাকে সে কারণ টাই বা কি!
নানারকম প্রশ্নে অস্থির হয়ে আছে নিয়ন্তার মন।
.
সোফার উপর বসে পড়লো সে। আজ প্রিয়া তাকে যেসব প্রশ্ন করেছে সেসবের বেশিরভাগই সঠিক জবাব সে দেয়নি।
বর্ণের সাথে বিয়ের আগে তার গর্ভে ইরা আসেনি। বরং বর্ণের সাথে বিয়ের পরেই ইরফানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলো নিয়ন্তা। যার ফসল ইরা।
বর্ণের সাথে বিয়ের এক মাস পরেই তার পরিবারের সকলে লন্ডনে গমন করলেও নিয়ন্তাকে একা রেখে বর্ণ যায়নি।
কদমহাটার নিজের বাড়িতেই নিয়ন্তাকে নিয়ে থেকে যায় সে।
বর্ণের পরিবারের প্রত্যেকেই নিয়ন্তাকে আপন করে নিয়েছিলো, কিন্তু নিয়ন্তাই তাদের আপন করে নিতে পারেনি।

বর্ণের সাথেও সম্পর্ক টা আগাতে পারেনি সে।
ইরফান তাকে ধোঁকা দিলেও কেনো যেনো নিজের মন থেকে ইরফানের নামটা মুছতে পারেনি সে। বারবার মনে হতো, ইরফান যদি তার ভুল বুঝে ফিরে আসতো!
নিয়ন্তার এই আশাটা পূরণ হবে জানা ছিলোনা তার। তাকে অবাক করে ইরফান তার ভুল বুঝে ফিরে এসেছিলো তার কাছে। তখন মাত্র নিয়ন্তার বিয়ের বয়স ছিলো ২মাস।
বর্ণকে পারিবারিক কাজে সাত দিনের জন্য কদমহাটার বাইরে যেতে হয়েছিলো আর তখনি ইরফানের সাথে এই ভুল পথে পা বাড়ায় নিয়ন্তা। অবশ্য নিয়ন্তা জেনে বুঝে এমনটা করেছিলো তা নয় কিন্তু।
বর্ণ যেদিন শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে বের হয় সেদিনই নিয়ন্তার ফোনে ইরফানের কল আসে। নিয়ন্তার কাজের বুয়ার সাহায্যে ইরফান তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারে এবং নিয়ন্তার ফোন নাম্বার জোগাড় করে, এমনটাই জানিয়েছে সে। ইরফান তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত ছিলো। ইরফানের ফোন পেয়ে নিয়ন্তার মনে ভালো লাগা কাজ করলেও বর্ণের কথা মনে হতেই তার আশার আলো নিভে যায়। বর্ণ কিছুতেই তাকে ছাড়বেনা এটা তার অজানা ছিলোনা। তাই ইরফানকে আর যোগাযোগ না করতে জানিয়ে দেয় নিয়ন্তা।
কিন্তু ইরফান ছিলো নাছড়বান্দা। সে অনবরত ফোন করতে থাকে নিয়ন্তাকে। একটিবার তার সাথে দেখা করার জন্য ব্যকুল হয়ে পড়েছিলো।
নিয়ন্তা নিজের মনকে শক্ত করে বলেছিলো, সে পারবেনা বর্ণকে ধোঁকা দিতে।
এতোসব কিছুর মাঝেও যে তার ভুল হয়ে যাবে এটা কখনো ভাবেনি নিয়ন্তা।
বর্ণ বাড়ি থেকে যাওয়ার ৪দিন পরেই ইরফানের ফোন আসে আবার।
বারবার রিং হওয়ায় ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও নিয়ন্তা তার ফোন রিসিভ করলো।
-তুমি কেনো আমাকে এভাবে জ্বালাতন করছো ইরফান?
-বুঝছো না?
-নাহ।
-আমি তোমার বাবার টাকা পরিশোধ করেছি নিয়ন্তা। এখন কোনো স্বার্থ নেই আমার বিশ্বাস করো। তোমাকে ভালোবাসি বলেই এমন পাগলামি করছি।
-আমি অন্য জনের স্ত্রী।
-যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেই সম্পর্কে কেনো তুমি আবদ্ধ থাকবে!
-কে বলেছে? কাজের বুয়া? ও কতটুক জানে আমাদের সম্পর্কে!
-আমি তাকে অঢেল পরিমাণে টাকা দিয়েছি নিয়ন্তা। সবটাই খবর নিয়েছে সে। তোমার শ্বশুড় রা লন্ডন যাওয়ার পর যে তোমরা আলাদা রুমে থাকো এসবও আমাকে বলেছে।
এসব বাদ দাও৷ একটাবার দেখা করো প্লিজ আমার সাথে!
-নাহ। আর হ্যাঁ, বর্ণ বাসায় আসলেই ওই বুয়াকে আমি বের করে দিবো বাড়ি থেকে। এখন একা বলেই...
-আমি আসবো আজ।
-তুমি আসবেনা ইরফান। আমি দেখা করবোনা তোমার সাথে।
.
কথাটি বলেই ফোন কেটে দিলো নিয়ন্তা।
ইরফানের সাথে এমন ব্যবহার করতে তার মোটেও ভালো লাগছেনা। কিন্তু সে এখন একটা সম্পর্কে আবদ্ধ। যেটা পবিত্র সম্পর্ক। বর্ণকে ঠকানো অন্যায় হবে। শুধু অন্যায় নয়, এটা পাপ!
.
এসব ভেবে ভেবে নিয়ন্তার বুকের ভেতর জ্বালাতন শুরু করে।
বুকের ভেতরে জ্বলা এই যন্ত্রণার আগুন নেভাতে তার পানি প্রয়োজন।
বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে বোতলটা হাতে নিতেই তার পাশেই রাখা মেডিসিনের বক্সটার দিকে নজর পড়লো নিয়ন্তার। মাইগ্রেনের সমস্যাটি তার খুব বেশি বলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঔষধ নিজের কাছে সবসময় রাখে সে। জমানো সেই ঔষধ গুলোর পাতা থেকে একটি একটি করে বেশ অনেকখানি ঔষধ খুলে হাতের মুঠে নিল নিয়ন্তা। পুরো এক বোতলের পানির সঙ্গে হাতে রাখা ঔষধগুলো নিয়ে একসাথে মুখে পুরে ঢকঢক করে গিলে ফেললো সে।
বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ধীরেধীরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো নিয়ন্তা।
.
.
রাত ১টা....
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো নিয়ন্তা।
কিন্তু তার শরীরে কারো হাতের স্পর্শ টের পেতেই চোখ জোড়া ধীরেধীরে খুললো সে।
চোখ খুলে ইরফানকে নিজের খুব কাছে দেখে নিয়ন্তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।
.
কাজের বুয়ার সাহায্যে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে নিয়ন্তার রুমে এসেছিলো ইরফান। বিছানার উপরে নাইটি পরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন নিয়ন্তাকে দেখে ইরফানের মনে তাকে কাছে পাওয়ার লোভ জাগে।
তাই সে সরাসরি নিয়ন্তার কাছে চলে যায়।
.
ইরফানকে এভাবে দেখতে পেয়ে ঘুমঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
তুমি এখানে!
-তোমার টানে...
-মানে?
.
আর কোনো কথা না বলে নিয়ন্তার সাথে মিশে যেতে থাকলো ইরফান।
নিয়ন্তা প্রথমে নিজেকে ইরফানের কাছ থেকে সরাতে চাইলেও ধীরেধীরে পরম আবেশে চোখ জোড়া আবারো বন্ধ করে নিয়ে ইরফানের ডাকে সাই দিলো সে।
তখনি নিয়ন্তা ঘুমের ঘোরে পা বাড়ায় এক ভুল পথে।
.
.
.
ঘড়িতে সময় সকাল ৭টা.....
নিয়ন্তার ফোন বেজে উঠলে সে মিটিমিটি করে চোখ জোড়া খুললো। কিন্তু চোখ খুলেই নিজেকে আবিষ্কার করলো সে কারো বুকের উপর। তাহলে বর্ণের সাথে কিছু হয়ে গেলো তার!
পরমুহূর্তেই আবার মনে পড়লো বর্ণ বাসায় নেই।
তাহলে কার বুকের উপরে পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছিলো সে?
.
সারা শরীরে কাপুনি দিয়ে উঠলো নিয়ন্তার। ভয়ে ভয়ে সে উঠে দেখলো ইরফানকে।
আস্তে আস্তে গতরাতের ঘটনা সবই মনে পড়ে গেলো নিয়ন্তার।
সে কি করে ফেললো! ইরফানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়লো সে!
ভাবতে ভাবতে আবারো নিয়ন্তার ফোনের রিং বেজে উঠলো।
বিছানার এক পাশে পড়ে থাকা চাদরটা গায়ে পেচিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিয়ন্তা।
টেবিলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো বর্ণের ফোন।
কাঁপাকঁাপা হাতে ফোন রিসিভ করে বললো-
হ্যালো?
-শুভ সকাল নিমপাতা।
-হু।
-আমি বলছি শুভ সকাল তিনি বলছেন হু!
-শুভ সকাল।
-এখন ঠিক আছে।
-এতো সকালে?
-তোমাকে ছাড়া মন টিকছেনা। এখানে জায়গা জমিন নিয়ে ঝামেলা হবে ভেবে তোমাকে সাথে আনিনি। আমার নিজেরও থাকতে হচ্ছে, যদিও কদমহাটা থেকে শ্রীমঙ্গল এতো দূরে নয়। কিন্তু জায়গা জমিনের ব্যাপার তো।
মনে হচ্ছে আরো বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে এখানে। তাই ভাবছিলাম...
-কি?
-তোমাকে এখানে নিয়ে আসবো।
আসবে?
.
কোন কিছু না ভেবে নিয়ন্তা জবাব দিলো-
আসবো।
-তৈরী হয়ে থেকো। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো।
-হুম। রাখছি এখন।
-নিমপাতা?
-হুম?
-ঠিক আছো তুমি?
-হ্যাঁ।
-ঠিক থাকলেই হলো। রাখছি।
.
যে বর্ণ তাকে এতো ভালোবেসেছে সেই বর্ণের বিশ্বাস এভাবে ভঙ্গ করতে পারলো সে!
নিজের সম্মান কি করে ইরফানকে বিলিয়ে দিতে পারলো সে!
এসব ভাবতে ভাবতে নিয়ন্তার চোখ যায় টেবিলের উপরে থাকা বক্সটার উপরে। যেখানে
মাইগ্রেনের মেডিসিন ছিলো, আর এসব খেয়েই তার বোধশক্তি ছিলোনা। যার কারণে ইরফানের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে একবারও ভাবেনি সে।
রাগে দুঃখে নিয়ন্তা বক্সটা নিয়ে ছুড়ে ফেললো।
পাশ থেকেই গায়ে শার্ট ঢুকাতে ঢুকাতে ইরফান বললো-
রিলাক্স নিয়ন্তা! কি হয়েছে? বর্ণ কিছু বলেছে?
.
রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তা বললো-
মাইগ্রেনের যন্ত্রনায় মেডিসিন নিয়েছিলাম। যা হয়েছে তাতে আমার হুশ ছিলোনা। থাকলে...
-থাকলেও আমার কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারতেনা তুমি। যাই হোক কাল বুঝলাম তুমিতো কুমারীই ছিলে। বর্ণের সাথে কিছুই হয়নি তোমার। আমিই তোমার...
-প্লিজ ইরফান!
.
নিয়ন্তার পাশে এসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে ইরফান বললো-
ডির্ভোস দিয়ে দাও বর্ণকে যত দ্রুত সম্ভব। আমরা দূরে কোথাও গিয়ে নতুনভাবে সব শুরু করবো।
.
নিজেকে ইরফানের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিয়ন্তা বললো-
তুমি এখন যাও।
.
.
শ্রীমঙ্গলে রওনা হওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলো নিয়ন্তা।
বর্ণকে সব খুলে বলতে হবে তার। কাল যা হয়েছে এবং তার মনে যা চলছে। বর্ণকে জানাতে হবে ইরফান-ই তার মনে রয়েছে। তাই বলে কাল যা হয়েছে তা ঠিক নয়। ইচ্ছে করে এমনটা করেনি সে। কিন্তু হয়ে গিয়েছে। সবটা জানার পর নিশ্চয় বর্ণ তাকে ছেড়ে দিবে। মিথ্যে সম্পর্ক, মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে লাভ কি!
.
.
-চা পাওয়া যাবে?
.
ইরফানের ডাকে ঘোর কাটলো নিয়ন্তার।
মৃদু হেসে সে বললো-
হু যাবে।
-শুনো?
-হু?
-আজ শ্রীমঙ্গল যাবো ভাবছি। বাড়িতে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে।
.
শ্রীমঙ্গলের কথা শুনতেই নিয়ন্তার বুকটা ধুক করে উঠলো। শান্ত গলায় সে বললো-
-হুম যাও।
-তোমার সাথে যাবো।
-আমার ইচ্ছে করছেনা।
-আমার সাথে যাবে, ইচ্ছে না করার কি হলো!
-অন্য কোনো দিন...
-থাক।
.
কথাটি বলেই ইরফান সদর দরজার দিকে এগুতে থাকে।
তাকে উদ্দেশ্য করে নিয়ন্তা বলে উঠলো-
কই যাচ্ছো? নাস্তাতো করে যাও?
-জাহান্নামে যাচ্ছি। ওখানেই করবো নাস্তা।
.
.
ইরফান বেরিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু তার কোনো খবর নেই।
.
নিয়ন্তা তার ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলো ইরফানের নাম্বারে। ইরফান রিসিভ করতেই সে বললো-
ইরফান তুমি কোথায়? আমি তোমার সাথে যাবো শ্রীমঙ্গল।
-আমি শ্রীমঙ্গল চা বাগানে আছি বন্ধুদের সাথে।
-ওহ!
-রাখছি এখন।
.
নিয়ন্তা বুঝতে পারলো ইরফানের অভিমান হয়েছে, যেটা স্বাভাবিক। তবে সে জানে কিভাবে ইরফানের মান ভাঙ্গা যাবে।
.
আলমারি খুলে একটা সবুজ রঙ্গের কাতান শাড়ি বের করলো নিয়ন্তা।
শ্রীমঙ্গল এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। নিজে গিয়ে আজ সারপ্রাইজ দিবে ইরফানকে।
কিন্তু নিয়ন্তা জানতোনা, সে নিজেই সারপ্রাইজ পেতে চলেছে আজ!
.
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)