ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১৪)
.
দুজনের বিয়ের ছবি দেখে নিয়ন্তা আবারো হারিয়ে যেতে থাকে স্মৃতির সাগরে।
.
.
বর্ণের ফোন নাম্বার পাওয়ার পরেই ইরফান তাকে ফোন করে দেখা করতে বললো।
ইরফানের কথামতো বর্ণ তার বাসায় সন্ধ্যায় দেখা করতে আসলো।
.
ইরফান তাকে দেখে সাদরে বাসার ভেতরে এনে সোফার উপরে বসতে বললো।
বর্ণ বসতে বসতে বললো -
বলুন কি বলবেন?
-নিয়ন্তার পেছনে লেগেছেন কেনো আপনি?
-আপনি কেনো লেগেছেন?
.
বর্ণের কথা শুনে এক গাল হেসে ইরফান বললো-
নিয়ন্তার বফ আমি। আমাকে এসব প্রশ্ন করা সাজে?
-নিয়ন্তার হবু বর আমি, আমাকে এসব প্রশ্ন করা সাজে?
-নিয়ন্তা আমাকে ভালোবাসে।
-আমি নিয়ন্তাকে ভালোবাসি। কথায় আছে জানেন তো, যে তোমাকে ভালোবাসে তাকেই কদর করো।
-আমিও বাসি নিয়ন্তাকে।
-ভুল।
-আপনি কি করে বুঝলেন?
-আগে বলুন আমি যেটা বলেছি সেটা সঠিক কিনা?
.
বর্ণের দিকে তাকিয়ে শয়তানি একটা হাসি দিলো ইরফান।
হাসতে হাসতেই বললো-
নিয়ন্তা কিন্তু এটাই বিশ্বাস করে। বেচারিতো আমার নাম বললেই পাগল। অবশ্য হবেনা কেনো! আমি দেখতে সুন্দর, স্মার্ট! প্রতিটা মেয়েই আমার মতো ছেলে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়।
-ওহহো! একটা ভুল কথা বলে ফেলেছেন। প্রতিটা মেয়ে আপনার মতো ছেলে তার জীবনে চায়না। একজন ভালো, আদর্শ মানুষ তার জীবনে চায়।
-নিয়ন্তা কিন্তু আমাকেই চায়।
-আপনার সত্যিটা জেনেও?
-জানতে কে দিচ্ছে! কে জানাবে তাকে? আমি তার বাবার টাকা পরিশোধ না করার জন্যই বিয়েটা করছি? কে জানাবে তাকে? আমি ওকে কোনো প্রধ্যান্যই দিবোনা। কে জানাবে ওকে? ওকে ছুড়ে ফেলতে আমি ২মিনিট ভাববো না।
কে জানাবে এসব? আপনি? বিশ্বাস করবেতো, ওই নিয়ন্তা এসব?
.
-ইরফান!
.
সদর দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ন্তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ইরফান।
টেবিলের উপরে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে মৃদু হেসে বর্ণ বললো-
হুহ! আমাকে আর কষ্ট করতে হলোনা। আপনিই সব জানিয়ে দিয়েছেন। শুধুশুধুই এতোক্ষণ কে জানাবে কে জানাবে করে মুখটা ব্যথা করছিলেন। হলো তো এখন?
.
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে নিয়ন্তা।
চোখে পানি টলমল করছে। মনে হচ্ছে এখুনি গড়িয়ে পড়বে।
বর্ণ যদি তাকে লুকিয়ে সব কথা শুনতে না বলতো, বিয়ের আগে সে ইরফানের আসল রুপ সম্পর্কে জানতে পারতোনা ভেবে বুকটা কেঁপে উঠলো।
.
নিয়ন্তার দিকে এগিয়ে আসলো বর্ণ।
পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ন্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো-
মনে হচ্ছে তোমার চোখের বৃষ্টি এখুনি ঝরঝর করে পড়তে শুরু হবে। মুছে নাও চোখ জোড়া।
.
বর্ণের হাত থেকে রুমালখানা নিয়ে নিয়ন্তা তার দিকে তাকিয়ে বললো-
বাবাকে বলুন। আমি আপনাকে বিয়ে করবো যত দ্রুত সম্ভব। আর হ্যাঁ ইরফান নামক ব্যক্তিটিকে বলুন, আমার বাবার টাকা আগামী তিনদিনের ভেতর যেনো শোধ করে। নাহলে আমি এর বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
.
.
.
-রুমে আসছোনা কেনো নিয়ন্তা?
.
ইরফানের করা প্রশ্নে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো নিয়ন্তা। এলবামটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
ওয়ারড্রব এর দিকে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ার খুলে এলবামগুলো রাখতে রাখতে বললো-
ঘুম আসছিলো না।
-আমার সাথে গল্প করলেই পারতে।
-ভেবেছি তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছো।
-এই কয়েকদিনে অভ্যাস করে ফেললে যে। তোমাকে ছাড়া ঘুম আসে নাকি!
.
নিয়ন্তা সামনের দিকে এগিয়ে আসতেই ইরফান তাকে কাছে টেনে নিলো।
আজ নিয়ন্তার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। কিন্তু কেনো সে জানেনা। না চাইতেও চোখ বেয়ে পড়ছে পানি।
নিয়ন্তার মুখটা নিজের মুখ বরাবর এনে ইরফান বললো-
কাঁদছো কেনো? হুম?
কাঁদলে আমার কষ্ট হয় জানোনা?
-হু।
-কি হু! ভেবেছিলাম এক কাপ চা করে দিতে বলবো তোমায়। কিন্তু মনে হচ্ছে চোখের পানি গুলোই ভাগ্যে ছিলো এখন।
.
কথাটি বলেই নিয়ন্তার চোখের গড়িয়ে পড়া পানি শুষে নিলো ইরফান।
.
চোখ জোড়া বন্ধ করে কান্নার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলো নিয়ন্তা।
তার দিকে খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর ইরফান বললো-
আজ তোমার চোখের পানিগুলো এমন নোনতা নোনতা কেনো? অন্যসময় অনেক মিষ্টি লাগে।
আজকের পানিগুলো কি বর্ণের জন্য ছিলো?
.
ইরফানের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো নিয়ন্তা।
গলাটা শান্ত করে বললো-
কই নাতো!
-এই না কথাটি বলতে গলা কেনো ধরে আসছে তোমার?
-আমি একটু একা থাকতে চাই।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে তাকে ছেড়ে দিলো ইরফান।
নরম স্বরে বললো-
থাকো।
.
.
.
নিজের রুমে চলে আসলো ইরফান। পায়চারি করতে লাগলো সে সারারুম জুড়ে।
.
যেদিন নিয়ন্তার বিয়ে হয়ে যায় বর্ণের সাথে সেদিনও ইরফান উপলব্ধি করতে করতে পারেনি, নিয়ন্তাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু দিন যত পার হচ্ছিলো নিয়ন্তার শূন্যতা ইরফান বুঝতে পারছিলো। তখন শুধু মনের মাঝে কষ্টটা চেপে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা।
সিগারেট, মদ এমনকি মেয়ের নেশায় পর্যন্ত ডুবে থেকে নিয়ন্তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো ইরফান। কিন্তু পারেনি। নিয়ন্তার মতন মেয়ের জন্য এভাবে পাগল হয়ে যাবে কখনো সে ভাবেনি।
একপর্যায়ে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হেরে গেলো ইরফান।
খবর নেওয়া শুরু করলো নিয়ন্তার। তখনি জানতে পারলো বর্ণের সাথে সম্পর্কটা আগাতে পারেনি নিয়ন্তা। বিয়ে বর্ণকে করলেও তার মনে জুড়ে রয়েছে শুধুই ইরফান। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে সে।
যার ফসল আজ নিয়ন্তা তার স্ত্রী।
কিন্তু আজ নিয়ন্তার চোখে বর্ণকে হারানোর বেদনা স্পষ্ট দেখেছে ইরফান। নিয়ন্তার কেনো খারাপ লাগছে বর্ণের জন্য? যাকে সে কখনো ভালোই বাসেনি।
হতে পারে বর্ণ মৃত। কিন্তু নিয়ন্তার চোখে বর্ণের জন্য অশ্রু দেখে হিংসে হচ্ছে ইরফানের, বড্ড হিংসে হচ্ছে।
.
.
.
সকালের মিষ্টি রোদের সঙ্গে জানালার পর্দার লুকোচুরি খেলা চলছে বেশখানিকক্ষণ হলো। একপর্যায়ে রোদ রুমের মাঝবরাবর প্রবেশ করতেই চলতি খেলার সমাপ্তি ঘটলো। আর তখনি পুরো রুমটা আলোয় চিকচিক করে উঠলো রোদের উত্তাপে। রুমের মাঝে প্রবেশ করা সেই এক টুকরো উষ্ণ রোদ মুখ বরাবর এসে পড়তেই ঘুমের ভাবটা কেটে গেলো নিয়ন্তার। আড়মোড়া ভেঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
.
ধীরেধীরে বিছানা থেকে নেমে সে পর্দাটা সরালো হাত দিয়ে।
পর্দা সরাতেই দেখলো প্রিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের উঠানে।
.
তাড়াহুড়ো করে নিয়ন্তা এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।
দরজা খুলে প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বললো-
কলিংবেল চাপলেই পারতেন?
-আসলে মাত্র সকাল ছ'টা বাজে। সংকোচ লাগছিলো।
-কিসের সংকোচ! ভেতরে আসুন।
.
সোফার উপরে বসতে বসতে নিয়ন্তা বললো-
কি খাবেন? চা নাকি কফি?
-এতো সকালে কেনো এসেছি জানতে চাইবেনা?
.
মৃদু হেসে নিয়ন্তা বললো-
তাতো চাইবো। চা বা কফি খেতে খেতেই না হয় শুনি?
-পরে খাবো। ইরফান উঠার আগেই কিছু কথা জানার ছিলো আমার।
-কি?
-বর্ণ কিভাবে মারা গেলো?
.
প্রিয়ার মুখে বর্ণের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো নিয়ন্তা।
আমতাআমতা করে সে বললো-
বর্ণের কথা আপনি কি করে জানলেন?
-তুমি যে অন্য কারো স্ত্রী এটা আমি জানতাম। কিন্তু তোমাকে আবার নিজের করে ইরফান পাবে এটা আমি মানতে নারাজ ছিলাম। তাই তুমি যেদিন এসেছো শুনেছি সত্যি কিনা দেখতে ছুটে এসেছিলাম। তোমাদের ব্যাপারে সব বলেছিলো আমাকে ইরফান। ওকে সবসময় তোমার জন্য আফসোস করতে দেখতাম। অনেক বেশিই ভালোবাসে ছেলেটা তোমাকে। আমিও ভাবতাম কোনোভাবে নিয়ন্তা যদি ইরফানের হতো! কিন্তু বর্ণের মৃত্যু কামনা করিনি। ভেবেছিলাম তোমাদের ডির্ভোস হয়েছে। এখন জানতে পারলাম বর্ণ আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু এই অল্প বয়সে সে কি করে অপারে চলে গেলো? তাহলে কি ইরার সাথে সেও এক্সিডেন্ট করেছিলো?
.
চোখ বেয়ে পানি পড়ছে নিয়ন্তার।
কোনো কথা তার মুখ দিয়ে আসছেনা।
.
-কি হলো? বলো কিছু?
.
প্রিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে নিয়ন্তা বললো-
-তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম আমি। ইরা এক্সিডেন্ট করেনি।
ইরাকে খুন করেছিলো বর্ণ।
.
নিয়ন্তার মুখে এমন একটা কথা শুনে চমকে গেলো প্রিয়া।
অবাক চোখে তাকিয়ে সে বললো-
-মানে! নিজের মেয়েকে কেউ খুন কেনো করবে?
-বর্ণের মেয়ে নয় ইরা।
-তাহলে?
-ইরা হলো ইরফানের মেয়ে।
-বুঝলাম না?
-আমি যখন বর্ণকে বিয়ে করি, আমার গর্ভে ইরফানের সন্তান ছিলো। পরে বর্ণ সেটা জেনে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু ভালোবাসতো বলে ছাড়তেও পারেনি।
ধীরেধীরে বর্ণ আমার কাছে আসতে চাইলেও আমি সবসময় দূরে দূরে থাকতাম। সে চেয়েছিলো আমাদের একটা বাচ্চা হোক। মানে বর্ণের বাচ্চার মা যেনো আমি হয়। কিন্তু ইরফান ছাড়া কারো সঙ্গই যেনো আমার ভালো লাগতো না। আমি তাই বর্ণকে এড়িয়ে চলতাম। একদিন বর্ণ আমার উপর জোড় জবস্তি করলো। আমি নিজেকে ওর থেকে রক্ষা করেছিলাম ওর মাথায় আঘাত করে। সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি আর সন্তান জন্মদান করতে পারবো না। ইরা আমার এক মাত্র সন্তান থাকবে। আর এটা যদি বর্ণ মানতে না পারে তাহলে আমায় ছেড়ে দেয়।
-তারপর?
-তারপর আর কি! বর্ণের কি হলো জানিনা। এসবের প্রতিশোধ সে আমার মেয়েকে মেরে নিলো। জানো আপু? বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে।
-আর বর্ণ কিভাবে মারা গেলো?
-আমি যখন বুঝতে পারি বর্ণ ইরার খুনী তখন তাকে জানাই, তার বাড়ি ছেড়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবো আমি আর এর আইনি ব্যবস্থা নিবো। কিন্তু তখন বর্ণ বারবার বলছিলো সে ইরার খুনী নয়। আমি ওর কোনো কথা না শুনে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। আর ঠিক তখনি....
-কি?
-বর্ণ নিজের পেটে নিজেই ছুরি ডুকালো।
-মানে আত্নহত্যা করেছে সে?
-হু।
-তার মানে সে সত্যিই ইরাকে খুন করেনি?
-জানিনা। কিন্তু বাসায় বর্ণ আর আমি ছাড়া কেউ থাকেনা। সেদিন আমি ইরার রুমে গিয়ে দেখতে পায় তার নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে রয়েছে, তার ঠিক পাশেই ছিলো বর্ণের হাত ঘড়ি।
-এরপর ইরফান কে কোথায় পেলে?
-ইরফান ঘটনার কদিন আগেই জানিয়েছিলো সে আগে যা করেছিলো সব ভুল ছিলো। সে আমাকে ভালোবাসে। আর তাই এসব ঘটে যাওয়ার পর ইরফানের সাথে আমিই যোগাযোগ করি। ইরফান আমাকে সেই রাতেই বিয়ে করে নিয়ে আসে এখানে।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়া। নিয়ন্তা কি তার কাছে কিছু লুকোচ্ছে নাকি এমন কিছু ঘটেছে যা নিয়ন্তার নিজেরই অজানা!
.
হালকা কেশে নিয়ন্তা প্রশ্ন করলো..
-তুমি এতোসব কিছু জানতে চাইলে কেনো?
-কৌতুহলবশত। আজ আসি আমি।
.
.
.
নিজের রুমে পায়চারী করছে প্রিয়া।
কেনো ইরা আর বর্ণ প্রিয়াকে দেখা দিচ্ছে প্রিয়া এখনো বুঝতে পারছেনা।
সেদিন যখন নিয়ন্তার বাড়ির সামনে বর্ণের আত্মাকে প্রিয়া দেখেছিলো সেদিন বর্ণ তাকে বলেছিলো, সে নিয়ন্তার স্বামী যার অকালে মৃত্যু হয়।
আর কোনো কিছুই সে জানতে পারেনি। রহস্য ভেদ করতে আজ নিয়ন্তার কাছে যাওয়া প্রিয়ার। কিন্তু নিয়ন্তার কথাগুলি প্রিয়ার কেনো যেনো বিশ্বাসই হচ্ছেনা। সত্যিই কি ইরার খুনী বর্ণ? আর সত্যিই কি বর্ণ আত্নহত্যা করেছে? আর এসব যদি সত্যি হয়ে থাকে ইরা আর বর্ণ কেনো দেখা দিচ্ছে প্রিয়াকে?
.
-আমার কথায় ভাবছেন?
.
পেছনে ফিরে বর্ণকে দেখে প্রিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে।
বর্ণকে উদ্দেশ্য করে সে বললো-
আজ নিয়ন্তা যা বলেছে সব কি সত্যি?
.
(চলবে)
Comments
Post a Comment