ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ৬)


নিয়ন্তার প্রশ্নের কোনো জবাব সে পেছন থেকে পাচ্ছেনা।
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে।
পেছনে ফেরার সাহস টাও তার নেই।
এদিকে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে ইরা।
নিয়ন্তা অসহায় দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকালো।
কি করা উচিত তার ভেবে পাচ্ছেনা কিছু।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত লম্বা হয়ে নিয়ন্তার পাশ কেটে গিয়ে ইরার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
এমন একটা অস্বাভাবিক কান্ড দেখে নিয়ন্তা এক দৌড়ে ইরফানের কাছে ছুটে গেলো।
-ইরফান উঠো? ইরফান? এই ইরফান?
.
চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে শোয়া থেকে বসে পড়লো ইরফান।
খানিকটা বিরক্তি নিয়ে নিয়ন্তার উদ্দেশ্যে সে বললো-
কি হলো?
-আমার ইরাকে নিয়ে যাচ্ছে।
-মানে?
-আমার ইরাকে নিয়ে যাচ্ছে ইরফান। কিছু একটা করোনা প্লিজ।
-তুমি কি বলছো এসব! স্বপ্ন দেখেছো?
-তুমি আসো আমার সাথে।
-কোথায়!
-আসোনা।
.

নিয়ন্তার সাথে ড্রয়িংরুমে এগিয়ে গেলো ইরফান।
ফ্যানের উপরে দেখিয়ে নিয়ন্তা বললো-
ওইতো....
-কি?
.
কাউকে দেখতে না পেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিয়ন্তা বললো-
-ইরা ছিলো এখানে। নিয়ে গিয়েছে ওকে।
-কি বলছো তুমি!
.
ইরাকে দেখতে না পেয়ে নিয়ন্তার মন অস্তির হয়ে উঠে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইরফানের কলার ধরে বললো সে-
তোমার জন্য হয়েছে সব। তোমার জন্য। কতোক্ষণ ধরে ডেকেছি তোমায়। ঘুমের জন্য অলসতা করলে তুমি। নিয়ে গেলোতো আমার মেয়েকে।
.
কথাটি বলেই নিয়ন্তা শব্দ করে কাঁদতে থাকলো।
.
ইরফান নিজের বাহুডোরে টেনে নিলো নিয়ন্তা কে।
শান্ত গলায় বললো সে-
তুমি স্বপ্ন দেখেছো। কেননা তুমি যেসব বলছো সেসব কিছুতেই সম্ভব নয়। ইরা...
কিভাবে কি সম্ভব বলো?
.
ইরফানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকে নিয়ন্তা।
ইরফান তার উদ্দেশ্যে বললো-
ঘুমোবে চলো।
.
.
.
সকাল ৬টা...
বাড়ির পেছনটায় পুকুরপাড়ে বসে আছে এলো চুলে নিয়ন্তা।
তার সাথে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা সে।
তবে যাই হোক, ইরাকে সে দেখতে পাচ্ছে এটাও কম কিসের!
কিন্তু সে যে আর কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। এটা কি সত্যি ছিলো?
.
আপনমনে এসব ভেবে লম্বা একটা দম ফেললো নিয়ন্তা।
.
-তোমার মনে বুঝি খুব দুঃখ?
.
পাশে তাকিয়ে নিয়ন্তা দেখতে পেলো একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে।
তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় নিয়ন্তা পাল্টা প্রশ্ন করলো-
আপনি কিভাবে বুঝলেন?
-এখানে বসে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতেছো।
-দীর্ঘশ্বাস ফেললেই বুঝি দুঃখে থাকে?
-তুমি ফেলছো তুমি জানোনা?
-হু।
-ইরফান তো ভালো ছেলে। ও তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে বলে মনে হয়না।
-আপনি চিনেন ইরফানকে?
-তার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছিলাম। কিন্তু জানাইছে সে নিয়ন্তা নামের কোনো এক মেয়েকে ভালোবাসে। সেই তুমিতো?
.
মুচকি হেসে নিয়ন্তা বললো-
হু। আর হ্যাঁ? ইরফান খুব ভালো। ও আমায় কষ্ট দেয়না।
-আমার বাসা একটু দূরেই। ইরফানের সাথে যাবা একদিন।
-নিশ্চয়। কিন্তু আপনিতো এসেছেনই এতোটা কাছে। চলুন ভেতরে?
-নাহ, আরেকদিন আসবো। এখন বাসায় অনেক কাজ। আসি।
.
.
.
বাইরে থেকে হেটে এসে নিজের রুমে প্রবেশ করে ইরফানের পাশে বসলো নিয়ন্তা।
সামান্য ঝুকে ইরফানের কানের নিচে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বললো সে-
শুভ সকাল সাহেব।
.
চোখ জোড়া মিটিমিটি করে খুলে ইরফান বললো-
আজ কই মাছ দিয়ে সিমের বিচি খাবো।
.
ইরফানের কথা শুনে হেসে নিয়ন্তা বললো-
উঠেই খাবারের কথা!
-হু। আজ দুপুরে আমার কয়েকটা বন্ধু আসবে। কাল বলেছিনা তোমায়?
-হুম, বাজারও করে এনেছিলে।
-কই মাছ অবশ্যই করবা কিন্তু।
-করবো। কিন্তু আমার যে এখন নানরুটি দিয়ে ঝোল খেতে ইচ্ছে করছে!
.
শোয়া থেকে উঠে বসে ইরফান বললো-
আমি দোকান থেকে নিয়ে আসছি এখুনি।
.
.
.
বেলা ১২টা....
প্রায় অনেক কাজ সেরে ফেলেছে নিয়ন্তা। কিন্তু কই মাছ এখনো কুটায় হয়নি। সিমের বিচিও ছোলা বাকি রয়েছে। এতো তরকারির মাঝে আজ এসব না খেলে কি চলতোনা ইরফানের!
একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিয়ন্তা একটা ছোট শ্বাস নিলো।
তখনি কলিংবেল এর শব্দ পেলো সে।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় সে দরজার দিকে।
কিন্তু দরজার বাইরে কাউকে দেখতে না পেয়ে রান্নাঘরের দিকে আবারো পা বাড়ালো নিয়ন্তা।
.
রান্নাঘরে এসে কই মাছ সুন্দরভাবে কাটা, সিমের বিচি ছোলানো দেখে নিয়ন্তার চোখ কপালে উঠে গেলো।
কিভাবে কি হলো সে কিছুই বুঝছেনা!
হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেলো ইরফানের গলা।
-বেলা ১২টা পার হতে চলেছে। আমি ওদের নিয়ে আসছি। তুমি রান্না সেরে নাও আস্তে আস্তে।
.
.
.
রান্না সেরে নিয়ন্তা ওয়াশরুমে আসলো।
এই সময়ে শাওয়ার এর নিচে কমপক্ষে ১ঘণ্টা তার দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
অনেকদিন পর সে এতো রান্না করেছে।
কিন্তু ইরফান তার বন্ধুদের নিয়ে চলে আসার সময় হয়ে গেলো।
তাই চটজলদি গোসল সেরে নিতে হবে এখন।
.
শাওয়ার ছেড়ে নিয়ন্তা গোসল সেরে নিয়ে শরীরে টাওয়াল পেচিয়ে নিলো।
.
হঠাৎ সে অনুভব করলো হালকা ঠান্ডা বাতাস তার শরীর স্পর্শ করছে।
আর পেছন থেকে কারো নিঃশ্বাস এর শব্দ ভেসে আসছে।
.
কে হতে পারে? বর্ণ?
.
সাহস করে নিয়ন্তা পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো মাথা ছাড়া একটা রক্তাক্ত শরীর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
.
এমন একটা দৃশ্য দেখে এক সেকেন্ডও দেরী না করে ওয়াশরুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো নিয়ন্তা।
তাড়াতাড়ি সে ওয়াশরুমের দরজা লক করে বিছানার উপর বসে হাপাতে লাগলো।
.
"হাহাহাহা হাহাহাহা হাহাহাহা.....
হিহিহি হিহিহি হিহিহি.... "
.
এমন বিকট শব্দে কারো হাসির শব্দ শুনে নিয়ন্তা সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো ইরাকে।
সে হেসে বলে যাচ্ছে-
আম্মুই ভয় পেয়েছে।
কি মজা! আম্মুই ভয় পেয়েছে।
.
ইরাকে দেখে শান্ত গলায় নিয়ন্তা তার দিকে তাকিয়ে বললো-
দুষ্টু মেয়ের কাজ এসব? আম্মুকে এভাবে ভয় দেখায় কেউ!
.
.
.
টেবিলটা নানারকম খাবারে সাজালো নিয়ন্তা।
একটু আগেই ইরফান ফোন দিয়ে বললো খাবার সাজিয়ে রাখতে তারা বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। এসেই তারা খেতে বসবে।
তার কথামতো নিয়ন্তা টেবিল সাজিয়ে নিয়ে সদর দরজা খুলে দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
চুলগুলো বাঁধেনি সে ভেজা ছিলো বলে।
নিয়ন্তা চুল আঁচড়িয়ে ভাবতে লাগলো কোন স্টাইলে বাঁধবে।
হঠাৎ মনে হলো তার প্রিয়ার কথা।
এক পাশে সিথি করে চুলে বেণী করে সেই বেণী সামনে এনে এক পাশে রাখে প্রিয়া। এই নরমাল স্টাইলেও কতো সুন্দর লাগে মেয়েটাকে!
সেও কি প্রিয়ার মতো সাজ দিয়ে দেখবে?
দেখাই যায়।
.
নিয়ন্তা তার পরণের শাড়িটা প্রিয়ার মতো করে পরে নিলো।
কুচি শাড়ি পরে আঁচল উপরে তুলে সুন্দর করে ভাজ করে পিন মেরে নিলো সে প্রিয়ার মতো।
চোখে ঘাড় কাজল দিলো, ঠোঁটে হাকলা লিপস্টিক, তারপর চুলে বেণী করে নিলো সে। এখন শুধু একটা চশমার অভাব। নাহলে পুরাই প্রিয়া হয়ে যেতো সে।
.
আপনমনে এসব ভেবে হাসতে থাকলো নিয়ন্তা।
হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে চেঁচামেচির শব্দ পেলো সে।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো সে সেদিকে।
.
-এইটা আমি খাবো।
-নাহ এটা আমি খাবো।
-আমি কিন্তু এখন কাঁদবো।
-কাঁদো!
.
দূর থেকে ইরাকে দেখতে পেলো নিয়ন্তা। টেবিলে বসে সে খাবার খাচ্ছে আর কথা বলছে কারো সাথে কিন্তু ইরার সামনে কে বসে আছে পেছন থেকে দেখতে পারছেনা নিয়ন্তা।
.
সে কি সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখবে কে সে?
-আম্মুই? দেখো আমার মুরগির রান খেয়ে ফেলতে চাইছে।
.
ভয়ার্ত কণ্ঠে নিয়ন্তা জিজ্ঞাসা করলো-
কে?
-আমি।
.
ইরার সামনে বসা লোকটির মুখের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলো নিয়ন্তা।
নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলো সে।
আর ঠিক তখনি কেউ তার রুমের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে এখুনি ভেঙ্গে ফেলবে দরজাটি।
আজ বুঝি তাকে মেরেই ফেলবে!
.
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)