কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (পর্ব ২৪)


ড্রাইভার গাড়ি থামানোর সাথে সাথেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে মেহেরীকা।
তার সাথে রাজীবও নামতে নামতে বললো-
কি হয়েছে মেহের?
.
কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে মেহেরীকা বুমি করতে থাকে।

রাজীব তার পাশে গিয়ে পিঠে হাত বুলাতে থাকে তার।
.
আচমকা রাজীবের বুকে মাথা রেখে মেহেরীকা বললো-
আমার খারাপ লাগছে।
-খুব বেশি?
-হু।
-পানি খাবে?
-না।
.
রাজীব খেয়াল করলো মেহেরীকার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
শক্ত করে মেহেরীকাকে জড়িয়ে ধরে সে বললো-
পাশেই একটা হাসপাতাল আছে, চলো ওখানে।
.
.
.
-কিসের এক্সিডেন্ট?
.
মিলির মুখে এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে সালেহা চৌধুরী দ্রুতবেগে তার দিকে এগিয়ে এসে মিলির হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে আরিফের উদ্দেশ্যে বললেন-
তুই আর আদি ঠিক আছিস তো?
-হুম মা, আমরা ঠিক আছি।
-আদিকে দে ফোনটা।
.
আদির হাতে ফোন দিতেই মায়ের উদ্দেশ্যে সে বললো-
মা আমি ঠিক আছি।
-তাহলে কার এক্সিডেন্ট হলো?
-আমাদের অফিসের একজন কর্মচারীর। ভাইয়ার মতে একজন পুরোনো, বিশ্বস্ত
কর্মচারী তিনি। বাবাও নাকি চিনেন।
-কিভাবে হলো?
-মোবাইলে টাকা রিচার্জ করার জন্য অফিসের পাশের দোকানটাই গিয়েছিলেন। ফেরার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগে।
-কি বলিস! এখন কেমন আছেন?
-ভালো নেই মা। দোয়া করো।
-তাতো করবই।
-আচ্ছা মা মেহেরকে একটু ফোনটা দাওতো।
-সেতো বাসায় নেই।
-বাসায় নেই মানে! কোথায় সে?
-কোথায় বেরিয়েছে তো বলেনি।
-এভাবে তোমরা ওকে বের হতে দিলে কেনো?
-আমিতো জানতাম না। দিবাকে বলেছে পরে বলবে কোথায় যাচ্ছে সে। আমিতো ভেবেছিলাম তুই জানিস।
-আচ্ছা মা, এখন রাখি। মেহের বাসায় ফিরলে আমায় বলো।
.
.
কোথায় গিয়েছে মেহের? সে কি তার ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে গিয়েছে?
তাই বুঝি ৪টাই বাসায় যেতে বলেছিলো তাকে! কিন্তু সেতো এই এক্সিডেন্টটার কারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। তাই মেহেরকে একটা ফোনও করতে পারেনি।
আর মেহের কিছু না বুঝেই অভিমান করে ফোনটা সুইচড অফ করে দিলো! এতো অভিমানী কেনো মেয়েটা?
এখন কোথায় খুঁজবে তাকে? এভাবে না জানিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি তার। কতো আপদবিপদ রয়েছে! নাহ, আশেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত।
.
মেহেরীকার খোঁজে আদি এক বাড়াতেই ডাক্তারের ডাকে থেমে যায় সে।
-রোগীর কি অবস্থা ডাক্তার?
-প্রচুর রক্ত লাগবে এ নেগেটিভ। কিন্তু আমাদের এখানে এই গ্রুপের কোনো স্টক নেই।
-আমার এ নেগেটিভ, আমি দিতে পারবো।
-তবে আরো প্রয়োজন।
.
ডাক্তারের কথা শুনে আরিফ বলে উঠে-
আমি দেখছি, রোগীর বাড়ির লোকদের খবর দিয়েছি। তাদেরও বলবো।
.
আদির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন-
তাহলে আপনি আসুন আমার সাথে।
.
আদি মোবাইল পকেট থেকে বের করে একটা মেসেজ লিখতে থাকে-
Ami jani Meher tumi kub rag koreco.Kinto ami sotti ekta jamelai pore giyecilam, tai aste parini.
Tumi ki tomar valobashar manuser kace cole giyeco Meher?
Jekanei thako pls amake janao.Tension hocce khub tomar jonno.
.
মেসেজটি লিখে সেন্ড করে সে মেহেরীকার নাম্বারে।
.
.
.
-রোগী কি হয় আপনার?
.
ডাক্তারের করা প্রশ্নে শান্ত গলায় রাজীব উত্তর দেয়-
আমার স্ত্রী।
-ওহ! আপনি একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। রোগীর একটা চেকাপ করাতে হবে।
-ঠিক আছে।
.
চেম্বার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে রাজীব কোরিডোরে থাকা সোফার উপর বসে পড়ে।
পকেটে হাত দিতেই তার মনে পড়ে মেহেরীকার মোবাইল তার কাছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সে অন করে সেটি। অন করার সাথে সাথেই একটা মেসেজ আসে।
.
আদিয়াত এর মেসেজটা পড়ে রাজীব খানিকটা অবাক হয়।
আদিয়াত জানে মেহেরীকা আর কাউকে ভালোবাসে, হয়তো আজ তার কাছেই চলে এসেছে।
এসব জানার পরেও আদিয়াত তার একটা খবর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে!
তবে কি আদিয়াতও তার মেহেরকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?
আর কিছু না ভেবে রাজীব ফোনটা আবার সুইচড অফ করে দিলো।
.
.
.
মিলির রুমের দরজার পাশে গিয়ে দিবা বললো-
ভাবী আসবো?
-আসোনা!
-আসলে ভাবী একটা জিনিস চাইতে এসেছিলাম তোমার কাছে।
-কি জিনিস?
-তোমার একটা কাতান সবুজ শাড়ি আছেনা? ওটা আজ আমায় পরতে দিবে?
-বাহবা! বিয়ে না করার আগেই বঁধু সাজতে চাইছো! কে বলেছে শুনি শাড়ি পরতে? তোমার হবু বর?
-হু।
-পুরো আলমারি তোমার ননদিনী।
নিয়ে যাও যা খুশি।
-ধন্যবাদ ভাবী।
.
-এই দিবা?
.
মায়ের ডাকে পেছনে ফিরে দিবা বললো-
হুম মা?
.
মিলির রুমের ভেতর সালেহা চৌধুরী প্রবেশ করে বললেন-
মেহেরীকার কোনো খোঁজ পেলি?
বিকাল ৫টা পার হতে চললো।
-না মা।
-কোথায় গেলো মেয়েটা! আমারতো খুব চিন্তা হচ্ছে।
.
তাদের কথপোকথন শুনে মিলি বলে উঠলো-
ওর বাড়িতে একটা খবর নিয়ে দেখবো মা?
-একদম না! উনারা চিন্তা করবেন যদি সে ওখানে না গিয়ে থাকে। ওর একটা বান্ধবী আছেনা? তার ফোন নাম্বার আছে তোমাদের কারো কাছে?
.
দিবা আর মিলি দুজনেই এক সাথে বলে উঠলো -
না।
.
হতাশমুখে সালেহা চৌধুরী বললেন-
আল্লাহ আমার মেয়েটা কোনো বিপদে পড়েনিতো!
.
.
.
নার্স এর ডাকে রাজীব ডাক্তারের চেম্বারে আবারো প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসলো।
হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার রুপা আক্তার বললেন-
অভিনন্দন। আপনি বাবা হতে চলেছেন।
.
ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে রাজীব হতভম্ব হয়ে যায়।
.
তার অবস্থা দেখে রুপা আক্তার বললেন-
আপনি কি বাচ্চা নেওয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন না?
.
তার কথা শুনে শান্ত গলায় রাজীব জবাব দিলো-
তা নয়।
-তাহলে মিষ্টি মুখ করান সবাইকে!
-জ্বী।
-এখন থেকে স্ত্রীর আলাদা যত্ন নিতে হবে আপনার।
-জ্বী।
.
.
.
কর্মচারীকে রক্তদান করে আদি করিডোরে এসে আরিফের উদ্দেশ্যে বললো-
ভাইয়া চল আমরা বাসায় যাই এখন। উনার বাসার সবাই এসেছেন, রক্তেরও ব্যবস্থা হয়েছে। আর চিন্তা নেই।
-হুম।
-তুই তাহলে তাদের সাথে কথা বলে আয়। আমি গাড়ি বের করছি।
-ঠিক আছে।
.
.
.
চেম্বার থেকে বের হয়ে মেহেরীকার হাত টেনে রাজীব তাকে হাসপাতালের এক কোণায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
ডাক্তার এসব কি বলছে মেহের?
-আহ আমার লাগছে রাজীব। হাত ছাড়ো।
.
মেহেরীকার হাত ছেড়ে শান্ত গলায় রাজীব প্রশ্ন করলো-
কিভাবে কি হলো মেহের?
-বুঝতে পারোনি?
.
মেহেরীকাকে কিছু বলার আগেই ফোনের রিং টোন বেজে উঠে রাজীবের।
পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো সুপ্তির ফোন।
রাজীব ফোন কানে নিয়ে মেহেরীকার কাছ থেকে একটু দূরে সরে আসতেই দেখা পায় সুপ্তির। একটু দূরেই সে কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তাকে দেখতে পেয়ে রাজীব তার পাশে গিয়ে বললো-
সুপ্তি?
.
পেছনে ফিরে অবাক চোখে তাকিয়ে সুপ্তি বললো-
তুমি এখানে!
-আমার কথা ছাড়, তুই এখানে কেনো?
-ফুফুর শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো ফুফু। বাসায় ফুফাও নেই। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই নিয়ে এসেছি এখানে।
-কি বলছিস! খুব ভালো করেছিস। কিন্তু হঠাৎ এমন হলো কেনো?
-মেহেরীকার কথা বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো।
-এখন কোথায় আম্মা?
-ওই যে ওই কেবিনে আছে।
স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।
-আচ্ছা আমি দেখে আসি।
.
পেছন থেকে মেহেরীকা বলে উঠলো-
তোমার সাথে আমিও যাই?
-আম্মার শরীরটা আরো বেশি খারাপ হোক তুমি চাও?
-নাহ।
.
আর কোনো কথা না বলে রাজীব এগিয়ে যায় তার মায়ের কাছে।
.
-তোমরা এখানে কেনো?
.
সুপ্তির প্রশ্নে মেহেরীকা জবাব দিলো-
আমার শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই।
-ওহ। ডাক্তার দেখিয়েছো?
-হুম।
-কি বলেছে ডাক্তার?
.
মাথা নিচু করে মেহেরীকা বললো -
তেমন কিছু নয়।
-তোমাদের বিয়ে কি হয়ে গিয়েছে?
-নাহ।
.
.
.
-কি করছিস আদি? গাড়ি ধীরে চালা।
.
আরিফের কথায় গাড়ি ধীরে চালাতে শুরু করলো আদি।
কেনো যেনো মনে হচ্ছে মেহেরীকাকে বাসায় পাবে সে।
যদিও একটু আগেও মায়ের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে সে ফিরেনি বাসায়। কিন্তু আদির মন বলছে মেহেরীকা ফিরে আসবেই।
.
.
.
কেবিন থেকে বের হয়ে সুপ্তির পাশ থেকে মেহেরীকার হাত ধরে টেনে আবারো হাসপাতালের কোণায় চলে যায় রাজীব।
গম্ভীর গলায় সে মেহেরীকার উদ্দেশ্যে বললো-
আমি সবটা বুঝেছি মেহের। কিন্তু তুমি কিভাবে এই বিষয়ে এতোটা কেয়ারলেস হলে?
-আমার মাথায় এসব কিছু আসেনি তখন।
-যেভাবে যাই হোক। এই বাচ্চাটা আমার বললেও আম্মা বিশ্বাস করবেনা। এমনিতেই আম্মা তোমাকে মেনে নিচ্ছেনা, তার উপর বাচ্চা!
-এখন কি করতে বলছো তুমি?
-এবরোশন।
.
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)