রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (পর্ব ৮)


ভোর বেলা ওরা বিছানাকান্দি পৌঁছায়। নিশুতি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। প্রায়াণ গাড়ির ইঞ্জিন অফ করে এক দৃষ্টিতে নিশুতির দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রায়ান কোনোদিনও ভাবেনি এভাবে একান্তে নিশুতির সাথে থাকার সুযোগ মিলবে কোনোদিন! ভাগ্য মানুষ কে কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যায় তা ভাগ্য নির্মাতা ছাড়া আর কেউই বলতে পারেনা। প্রায়াণ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যেন এই মেয়েটাকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে সে।
তারপর হালকা গলায় ডাকে,
--------নিশুতি..
নিশুতি নড়ে উঠে। কিন্তু পুরোপুরি ঘুম ভাঙে না। প্রায়াণ আবারো ক্ষীণ আওয়াজে ডাকে,
---------এই নিশুতি..
নিশুতি "উম উম" করে। প্রায়াণকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর সিটের অন্যদিকে ঘুরে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।
প্রায়াণ হেসে কুটিকুটি হয় নিশুতির অবস্থা দেখে। কে বলবে এই মেয়ের বয়স ১৯ কি ২০! একদম ৬-৭ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে যেন! প্রায়াণের ইচ্ছে করে নিশুতির খোলা কপালে তার অধর স্পর্শ তুলে দিতে।
নিশুতির বাহুতে একটা গুতো মারে প্রায়াণ।
নাহ! কোনো হুশ নেই তার। ভুস ভুস করে ঘুমাচ্ছে নিশুতি। প্রায়াণ মৃদু হেসে নিশুতির কপালের কাছে মুখ নেয় তার। তারপর....
১ সেকেন্ড.... ২ সেকেন্ড.... ৩সেকেন্ড......
প্রায়াণ নিশুতির কপালে নিজের অবাধ্য ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দেয় কিন্তু খুব আলতো করে। পাছে নিশুতির ঘুম না ভেঙে যায়!
নিশুতি টের পায় কিনা কে জানে! কিন্তু সে সামান্য নড়েও না। আগের ন্যায় ঘুমে কাতর!
প্রায়াণ নিশুতির চোখে মুখে আছড়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দেয় আঙুল দিয়ে। তারপর ঘড়ি দেখে।
ভোর পেরিয়ে সকাল হয়ে আসছে প্রায়...গাড়িতে এভাবে থাকা ঠিক না। একটা রিসোর্টে উঠা দরকার দ্রুতই..
প্রায়াণ গাড়ি স্টার্ট দেয়। একটানে একটা রিসোর্টের সামনে গিয়ে থামে গাড়ি। এবার জোর গলায় ডাকে নিশুতিকে প্রায়াণ। নিশুতি ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে।
রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলে,
-------কি সমস্যা? ঘুমাতেও দিবেন না নাকি! ডাকছেন কেন??
প্রায়াণ অবাক হয়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
-------সারা রাত ঘুমাতে ঘুমাতে আসছো! আর এখনো ঘুম হয়নাই?? আর আমি যে সারারাত ড্রাইভ করে আসলাম,সেটা কী?
নিশুতি থতমত খায়। এভাবে বলা টা ঠিক হয়নি তার...
নিশুতি জানালা দিয়ে বাহিরে মুখ করে নিচু গলায় বলে,
--------সরি।
--------হুম। এবার ঠিকঠাক হয়ে নাও। আমরা বের হবো।
নিশুতি অবাক হয়। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে তার। বলে,
-------কোথায় বের হবো?
-------গাড়িতেই আজীবন পার করে দেওয়ার ইচ্ছে নাকি তোমার?? সামনে দেখো। রিসোর্টে যাবো।
নিশুতি গাড়ির সামনের কাঁচ ভেদ করে বাহিরে তাকায়। কয়েক কদম এগোলেই একটা রিসোর্ট মাথা উঁচু করে শাহী ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে কখনো রিসোর্ট দেখেনি নিশুতি। দেখবেই বা কোত্থেকে! সে তো এর আগে ঘুরতেও বের হয়নি কখনো!!
নিশুতি মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,
-------কি সুন্দর রিসোর্ট!
প্রায়াণ শুনতে পায় তা।
পেছনের সিট থেকে নিশুতির ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে বলে,
-------আরো এমন অনেক কিছু আছে যা দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবা। বুঝছো? এবার চলো।
.
.
দুজনের জন্য দুটি রুম নেওয়ার উচিত থাকলেও প্রায়াণ একটি রুমই নেয়।
রুমে ঢুকে নিশুতি প্রায়াণের সামনে দাঁড়িয়ে সোজাসাপটা বলে,
-------আপনি এক রুম কেন নিলেন?? আমার সাথে থাকার প্ল্যান আছে নাকি??
প্রায়াণ রুমের চাবি ডিভানের উপর রেখে বলে,
-------আরে যদি একা এক রুমে থাকতা আর যদি জ্বীন আসতো তখন?? ভয় পেতা না?
নিশুতি প্রায়াণের সামনে এসে বিরক্ত মুখে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়। প্রায়াণ জিহ্বে কামড় কাটে। নিশুতি তো আগেই বলেছে যে সে জ্বীন ভূতের এসবে এত বিশ্বাসী না!!
প্রায়াণ ধরা পরে যাওয়া চোরের মতো মুখ করে নিশুতির দিকে তাকায়। নিশুতি মুখে বিরক্তি নিয়েই বলে,
-------ঠিক আছে একরুমেই থাকুন আমার সাথে কিন্তু ডোন্ট ডেয়ার টু কাম ক্লোজ টু মি ওকে??
প্রায়াণ এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে বলে,
-------ওকে ওকে।
.
.
প্রায়াণ চুপ করে বিছানায় বসে আছে। নিশুতি ফ্রেশ হতে গিয়েছে ওয়াশরুমে। নিশুতি বের হয়ে বলে,
-------এবার আপনি যান।
প্রায়াণ নিশুতির কথায় নড়েচড়ে উঠলেও বসেই থাকে। ওয়াশরুমে যায় না।
নিশুতি ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে প্রায়াণের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
-------কি ব্যাপার যাচ্ছেন না কেন? কোনো প্রবলেম??
প্রায়াণ ক্ষীণ স্বরে বলে,
--------না।
নিশুতি এসে প্রায়াণের সামনে দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে নিছক মজার ছলে বলে,
--------পিরিয়ড হয়েছে নাকি? এভাবে কুঁকড়ে বসে আছেন কেন??
প্রায়াণ চোখ বড়বড় করে তাকায়। মাথা চক্কর দিচ্ছে তার। মেয়েটা এত পাজি কেন??
নিশুতি প্রায়াণের গায়ে ধাক্কা মেরে বলে,
-------আরে মজা করছি। বলেন না। কি হইছে??
প্রায়াণ নিচুগলায় বলে,
-------আমি তো কোনোকিছু নিয়ে আসি নি। জামা কাপড় বা গামছা! কিছুই না। জামা কাপড় তো পরে কিনে নিতে পারবো কিন্তু গামছা টা তো...
নিশুতি বুঝতে পারে। নিজের আধো ভেজা গামছা টা প্রায়াণের দিকে তুলে ধরে বলে,
-------আমার চুলের পানিতে হালকা ভিজে গেছে। এটা চলবে??
প্রায়াণ উল্লাসিত কণ্ঠে বলে,
--------দৌড়োবে।
প্রায়াণ নিশুতির গামছা হাতে ওয়াশরুমে চলে যায়। নিশুতি মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে যাবতীয় জিনিস পত্র বের করে। কেন জানি প্রায়াণ ছেলে টাকে ভালোই লাগে তার!
.
.
.
শারমিন হোসেনের চিৎকারে ঘুম ভাঙে আজহার হোসেনের। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে তিনি। গলা চওড়া করে ডাকে শারমিন কে। শারমিন হোসেন কাছে আসতেই চেঁচিয়ে বলে,
-------সকাল সকাল কি শুরু করছো বলো তো! চিল্লাছো কেন??
শারমিন হোসেন বিছানায় বসে বিলাপ পেরে বলেন,
--------তোমার ঐ ডাইনি মেয়ে। সারা বাসায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজকে ওর বিয়ে আর ও যদি পালিয়ে থাকে তখন??
আজহার হোসেন বিছানায় শুয়ে বলেন,
--------যতসব ফালতু চিন্তা!! দেখো ছাদে আছে বোধহয়।
---------নেই। আমি সব খুঁজেছি। কোথাও নেই।
এবার আজহার হোসেন আর শান্ত থাকতে পারেন না। লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন। গলা চওড়া করে ইফতি কে ডাকে। ইফতি জানে তার এইধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই সে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল।
চোখ ডলতে ডলতে এসে বলে,
-------কি আব্বু? ডাকছো যে! এত সকাল সকাল।
আজহার হোসেন ছেলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলেন,
-------নিশুতি কই??
ইফতি অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
-------আপুর রুমে দেখো।
--------সে তার রুমে নেই। সে কোথাও নেই। সে বাসা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি সিউর তুই জানোস ও কই আছে। বল ও কই??
ইফতি অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
--------হোয়াট!! কি বলছো এসব?? আপু পালিয়েছে মানি??? আপু নেই???
আজহার হোসেন রাগ চাপিয়ে বলেন,
--------না।
এবার ইফতি হাউমাউ টাইপ কাঁদা শুরু করে। চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হয় কিনা সন্দেহ! কিন্তু তার বিলাপ দেখে কে...!
আজহার হোসেন মারতে উঠেন ইফতিকে।
------ঢং করবি না। আমি জানি তুই জানিস ও কোথায় আছে। চুপচাপ বলে দে সত্যিটা।
ইফতি মায়ের গলা জরিয়ে ধরে বলে,
--------মা তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো নাকি? আমি সত্যিই জানিনা আপু কই৷ বিশ্বাস করো।
শারমিন হোসেন বিশ্বাস করেন ইফতির কথা। তিনি আজহার হোসেন কে ধমকে উঠেন।
------আহা ইফতি যখন বলছে ও জানে না। তার মানে ও হয়তো সত্যিই জানে না। এত চেঁচাচ্ছো কেন তবুও ওর সাথে??? আমি সিউর তোমার ভাইয়ের কাছে গেছে।
তাকে ফোন করে দেখো।
আজহার হোসেন শান্ত হন কিছুটা। বলেন,
-------হুম।
.
.
নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দেয় ইফতি। সারারাতে অনেকবার ফোন করেছে নিশুতিকে। একবারও ধরেনি মেয়েটা। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে ইফতির।
এখন আবার ফোন দেয়। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে নিশুতি বলে উঠে,
------হ্যালো ভাই।
------কোথায় ছিলি তুই হ?? কতবার কল দিছি সারা রাতে জানোস??
-------সরি ভাই। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গাড়িতে।
ইফতি ঠান্ডা হয়। নরম গলায় বলে,
--------এখন কই আছিস?
--------বিছানাকান্দি। একটা রিসোর্টে। কিছুক্ষণ আগেই এসেছি।
-------ঠিক আছে নিজের খেয়াল রাখিস। টাকা যা লাগে আমাকে জানাবি
নিশুতি জবাব দেয় না। তার তো একটা টাকাও খরচ হয়নি এই পর্যন্ত! সব প্রায়াণই খরচা করছে৷
ইফতি বলে,
-------এখন রাখছি। নিজের খেয়াল রাখিস।
-------তুইও নিজের খেয়াল রাখিস ভাই।
ইফতি ফোন কেটে দেয়। ফোন টা আবার ব্যাগের ভেতর ভরে বিছানায় শোয় নিশুতি। সারারাত বসে ছিল গাড়িতে। পিঠ ব্যথা করছে তার।
.
.
প্রায়াণ শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে নিশুতি বিছানায় বেতাল হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই তার। প্রায়াণ মৃদু হাসে। মেয়েটা এত ঘুম কই পাই! কে জানে.....
প্রায়াণ বারান্দায় গামছা টা শুকাতে দিয়ে এসে সোফায় শোয়। তারও এখন ঘুমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন একটু। সারারাতে একবারের জন্যেও চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
.
.
.
সন্ধ্যার আগে আগে ঘুম ভাঙে নিশুতির। মিটমিট করে চোখ খুলতেই দেখে এক জোড়া উৎসুক চোখ তার দিকে তাকিয়ে।
নিশুতি আড়মোড়া ভেঙে বলে,
---------গুড মর্নিং।
প্রায়াণ মুচকি হেসে বলে,
---------গুড ইভেনিং।
নিশুতির ঘুম উড়ে যায় চোখ থেকে। এখন বিকেল! আল্লাহ! এত ঘুমিয়েছে সে....!
নিশুতি উঠে বসে।
মিনমিনে গলায় বলে,
-------এতক্ষন ঘুমিয়েছি! বুঝতেই পারলাম না।
-------শরীর ক্লান্ত ছিল তাই ঘুমিয়েছো। ইটস ওকে।
নিশুতি প্রতিউত্তরে কিছু বলে না। ভালো করে লক্ষ্য করে প্রায়াণ কে। একটা কালো ট্রাউজারের সাথে কালো টি-শার্ট! উফ...ছেলেটাকে এত কিউট লাগছে কেন আজকে!
চলবে.....

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২১)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)