ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ১৩)


প্রিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ন্তা প্রশ্ন করলো-
আপু আপনার স্বামী কিভাবে আমাদের না দেখেই এতো নিখুঁতভাবে ছবিটা এঁকেছেন?
.
নিয়ন্তার করা প্রশ্নে হালকা হেসে প্রিয়া বললো-
আমি তোমাদের বর্ণনা দিয়েছিলাম। তা শুনেই আঁকলো আরকি।
-বর্ণনা শুনেই এতো ভালো আঁকতে পারেন! না জানি সরাসরি দেখলে কিভাবে আঁকতেন!
.
নিয়ন্তার কথা শুনে হাসতে থাকলো প্রিয়া।
.
তার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিয়ন্তা।
সে যদি ছেলে হতো নির্ঘাত প্রিয়া নামক মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দিতো।
কিন্তু প্রিয়া তার স্বামীর সাথে কেনো দেখা করায়নি?
.
-কি ভাবছো?
.

প্রিয়ার ডাকে ঘোর কাটলো নিয়ন্তার।
প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-
ভাইকা কে ধন্যবাদ দিতে চাই। কিভাবে দিবো?
-তোমার পক্ষ থেকে আমি দিয়ে দিবো।
-আচ্ছা।
-ইরফান কোথায়?
-জয়ার ফোন এসেছিলো। সে ওখানে। তুমি চেনো তাকে?
-হু। সেতো ইরফানের জন্য পাগল ছিলো। আমাকেও বলেছিলো ইরফানকে তার হয়ে সুপারিশ করার জন্য।
-তাই নাকি! চলো আমার রুমে। আজ গল্প করি তোমার সাথে। সমস্যা নেইতো?
-উম্ম...
নাহ নেই।
.
.
.
-বাবাই তুমি এতোদিন আসোনি কেনো?
.
আলিনার করা প্রশ্নে হালকা হেসে ইরফান বললো-
কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
-আমিতো দূরে চলে গিয়েছিলাম। আবার আসার পর তুমি দেখতেই আসোনি। তার মানে তুমি খুশি হতে আমি না আসলে। তাইনা?
.
আলিনাকে কোলে নিয়ে তার গালে একটা আদর দিয়ে ইরফান বললো-
আমার মামুনি দেখি সেই রাগ করেছে! কিভাবে কমবে রাগ তোমার?
-আম্মু না আসা পর্যন্ত এখানে থাকবে তুমি। রাজি?
-হু, রাজি।
.
জয়ার কাছে যাওয়ার পথে ইরফানের ফোনে জয়ার আবারো কল আসে। তখন জয়া জানায় ইরফানের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কোন বিপদে সে পড়েনি। বাসার সবাই তার ফুফুর বাসায় গিয়েছে বলে পুরো বাড়ি ফাঁকা ছিলো। আর তাই সে ইরফানের সঙ্গ পাওয়ার জন্য তাকে ডেকেছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এটা অন্যায়। কেননা ইরফান এখন বিবাহিত। আর তাই সে আবার ফোন করে সব সত্যিটা ইরফানকে জানিয়েছে।
ইরফানও সুযোগ পেয়ে আলিনার সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু এখানে এসে রকির কাছে জানতে পারলো প্রিয়া বাড়িতে নেই। সে নাকি তাদেরই বাসায় গিয়েছে।
যেহেতু নিয়ন্তা একা নয় সেহেতু আলিনার সাথে একটু সময় কাটানোই যায়।
.
আপনমনে এটা ভেবে আলিনার সাথে খেলায় যোগ দিলো ইরফান।
.
.
.
রাত ১০টা....
সময় অনেকটা হয়ে যাওয়াই প্রিয়া নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ন্তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
নিয়ন্তার বাসা থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম সামনে এগুতেই কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে নিশ্চুপভাবে।
তাকে দেখে প্রিয়াও দাঁড়িয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে প্রিয়া বললো-
আপনি একটা আত্মা। কিন্তু নিয়ন্তার বাড়ির সামনে কি করছেন?
.
পেছনে ফিরে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বর্ণ বললো-
আমার যে এখানেই থাকতে হবে।
-মানে! কে আপনি?
-বর্ণ।
.
.
.
রাত ১০টা বেজে গেলো। কিন্তু ইরফানের কোনো খবর নেই। সে কি একটা ফোন দিয়ে দেখবে?
নাহ থাক।
.
নিজেরমনে এসব ভেবে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো নিয়ন্তা।
চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকলো সে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে চোখ বন্ধ করলেই বর্ণকে দেখতে পারছে সে।
.
কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর নিয়ন্তা উঠে বসলো।
লম্বা কয়েকটা দম ফেলে আবারো বর্ণের ভাবনায় তলিয়ে গেলো সে।
.
বর্ণের ফোন আসার পর বাবার কাছে হনহন করে হেটে গেলো নিয়ন্তা।
কি বলেছে সেই ছেলে! তার বাবা নাকি ওই ছেলের সাথে তার বিয়ে দিবে!
আসলেই কি বাবা এমনটা বলেছে! তার কাছে গেলেই জানা যাবে।
.
নিজেরমনে কথাগুলো বলে রিজাউল কবিরের রুমের দরজায় কড়া নাড়লো নিয়ন্তা।
-বাবা আসবো?
-আয় মা। ভেতরে আয়।
.
নিয়ন্তা ভেতরে এসে সরাসরি রিজাউল কবিরকে জিজ্ঞাসা করলো-
বর্ণমালার সাথে নাকি আমার বিয়ে দিবে বলেছো?
-নাতো!
-আমি জানতাম তুমি এমনটা করতেই পারোনা।
-হুম, আমিতো বর্ণের সাথে তোর বিয়ে দিবো বলেছি। মালা টালা আসলো কোথা থেকে!
.
রিজাউল কবিরের কথা শুনে নিয়ন্তার চোখ কপালে উঠে গেলো। তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললো-
আমি ইরফানকে ভালোবাসি।
-আমি মানিনা।
-তাতে আমার কিছু আসে যায়না। আর ইরফানকে না মানার কারণ কি বাবা?
-ছেলেটা তোকে ভালোবাসে না।
-তুমি কি বুঝো ভালোবাসার মানে?
-বুঝি। বুঝি বলেই বলছি, বর্ণ তোকে ভালোবাসে।
-সব তুমিই বলবে?
-হুম। আগামী সপ্তাহেই তোদের বিয়ে।
.
আর কোনো কথা না বলে নিয়ন্তা বেরিয়ে যায় রিজাউল কবিরের রুম থেকে।
.
.
নিজের রুমে পায়চারী করছে নিয়ন্তা। এতোক্ষণ যাবৎ ইরফানকে ফোন করে সে পায়নি।
ইরফানের কথা ভাবতে ভাবতে তখনি তার মোবাইল এর রিংটোন বেজে উঠলো৷ স্ক্রিনে না তাকিয়ে ফোন কানে নিয়েই সে বলে উঠলো-
জান কতোবার কল দিয়েছি তোমাকে?
-কই? দেখিনিতো।
.
ইরফানের গলার আওয়াজ নিয়ন্তার অজানা নয়। কিন্তু এখন ওপাশ থেকে যে কথা বলছে সে ইরফান নয়। তবে কে!
.
-আরে আমি বর্ণ!৷ জান যে আমাকে ডাকোনি আমি বুঝেছি।
তবে শুনো ওসব বফ কে জান ডাকা বাদ দিয়ে দাও। কদিন পরেই যে আমাদের বিয়ে! তাই ইরফানের সাথে আজই ব্রেকাপ করে ফেলো।
.
বর্ণের কথা শুনে গা জ্বালা করতে থাকে নিয়ন্তার।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বললো-
তোর ব্যবস্থা আমি করছি।
-এইরে! হবু স্বামীকে কেউ তুই করে বলে নাকি!
.
ফোনের লাইন কেটে দিলো নিয়ন্তা। ইচ্ছে করছে তার হাতে থাকা মোবাইলটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে। ঠিক তখনি একটা মেসেজ আসলো তার ফোনে।
-Congratulation Niyonta. Tumi amar bou hote coleco.
.
বর্ণের মেসেজ পেয়ে মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার অবস্থা নিয়ন্তার।
এই ছেলেটা এতোটা ছ্যাচড়া ভাবেনি সে আগে।
এভাবে তাকে প্রশ্রয় দেওয়াটাও ঠিক হবেনা। আর তাই কোনো একটা ব্যবস্থা নিতেই হবে। কিন্ত ইরফানের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়।
.
আপনমনে এসব ভেবে ইরফানের নাম্বারে আবারো ডায়াল করে নিয়ন্তা।
এবার রিসিভ করলো ইরফান।
এক গাল হাসি নিয়েই সে বললো-
হেই জান?
-রাখো তোমার জান টান।
.
নিয়ন্তার কথা শুনে ইরফানের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
বিরক্তিভরা কণ্ঠ নিয়ে সে বললো-
কি হলো?
-কি হয়নি তা বলো!
-কথা না পেচিয়ে বলোতো কি হয়েছে?
-তোমাকে বর্ণের কথা বলেছিলাম না?
-হুম।
-বাবা তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।
-মানে?
.
ইরফানকে সব খুলে বললো নিয়ন্তা।
সবটা শুনে ইরফান বললো-
চিন্তা করোনা। ওই বর্ণের ফোন নাম্বারটা দাও আমায়।
.
.
কলিংবেল এর শব্দে ভাবনার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসলো নিয়ন্তা।
বিছানা থেকে উঠে দরজাটা খুলে দিলো সে।
.
ইরফান ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করতে করতে বললো-
নিশ্চয় খাওনি তুমি? খেয়ে নাও। আমি খেয়ে এসেছি।
.
ইরফান এগুতে চাইলে নিয়ন্তার ডাকে থেমে যায়। পেছনে তাকিয়ে বললো-
হুম?
-জয়া ঠিক আছে?
-হুম আছে।
-কি হয়েছিলো?
-শরীর খারাপ ছিলো।
.
.
রাত ১২টা হয়ে গেলো, নিয়ন্তা এখনো নিজের রুমে আসেনি।
.
ইরফান বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপাটিপি করছিলো।
গ্যালারি তে গিয়ে সে ছবি দেখছিলো। দেখতে দেখতে নিয়ন্তার সাথে ইরার ছবিও দেখতে পায় সে।
ইরার ছবির দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ইরফান। আজ আলিনাকে দেখেও ইরার কথা তার মনে পড়েছে। তাই আলিনার আবদারে রাতের খাবারটাও ওখানে সেরে আসতে হয়েছে তার।
.
ইরার ছবির দিকে তাকিয়ে ইরফানের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো।
না চাইতেও তার চোখ বেয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু পানি।
সে খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে নিয়ন্তার সাথে, নিজের সাথেও। কিন্তু এই ভুলের মাশুল কিভাবে দিবে সে!
.
.
অন্যরুমের ওয়ারড্রব এর ড্রয়ারে কিছু এলবাম রেখেছিলো নিয়ন্তা।
আজ এসব তার বড্ড বেশিই দেখতে ইচ্ছে করছে।
ড্রয়ার খুলে নিয়ন্তা এলবামগুলো বের করে বিছানার উপরে বসলো।
এলবাম উল্টাতেই তার চোখ যায় বর্ণ আর নিজের ছবির দিকে।
লাল শাড়ি পরে বউ সাজে বসে আছে সে আর তার পাশেই বরের বেশে বসে আছে বর্ণ।
বর্ণ আর নিজের বিয়ের ছবি দেখে বুকটা ধুক করে উঠলো নিয়ন্তার।
.
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)