ধোঁয়াশা - সাজি আফরোজ (পর্ব ৯)


ড্রয়িংরুমে যেতেই সদর দরজা বন্ধ দেখতে পেলো নিয়ন্তা।
দ্রুতবেগে এগিয়ে গিয়ে সে দরজা খুলে উঠোনে গেলো।
বৃষ্টির মাঝেই ভিজতে ভিজতে বললো-
কে তুমি? আজ তোমায় দেখা দিতেই হবে। দেখা দাও বলছি।
-খুঁজে দেখো পাবে আমায়, আমি সেই চিরচেনা।
.
কথাটি দূর থেকে ভেসে আসতেই নিয়ন্তা ঘাবড়ে গেলো।
ধীরপায়ে পেছনের দিকে পিছিয়ে গিয়ে বারান্দার উপরে ধপাস করে বসে পড়লো সে।
বৃষ্টির ফোটার সাথে তার চোখের পানি মিশে একাকার হতে লাগলো।
পুরো শরীরে ঠাণ্ডা অনুভব করছে সে। তবুও কেনো যেনো গভীর ভাবনায় তার তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
হুম, বর্ণের কথা মনে পড়ছে তার।
তার সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলোর কথা ভাবতে বড় ইচ্ছে করছে।

চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ন্তা হারিয়ে যেতে থাকে ভাবনার জগতে সেই দিনটিতে, যেদিন বর্ণের সাথে তার প্রথম দেখা হয়।
.
.
লাকাতুরা চা বাগানে খালাতো বোনদের নিয়ে হেটে চলেছে নিয়ন্তা।
ঠিক তখনি তার পায়ের একটা নুপুর পা থেকে পড়ে যায় যা নিয়ন্তা খেয়ালই করেনি।
তাদের পেছনেই বন্ধু মুফিজকে নিয়ে হাটছে বর্ণ।
সে খেয়াল করলো সামনে হেটে যাওয়া মেয়েটির একটি নুপুর পড়ে রয়েছে মাটিতে।
বন্ধু মুফিজকে দাঁড়াতে বলে সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নুপুরটি হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো-
শুনছেন?
.
নিয়ন্তারা পেছনে ফিরতেই বর্ণের চোখ যায় নিয়ন্তার উপর। কোঁকড়ানো চুল, শ্যামবর্ণের মেয়েকে দেখতেও এতোটা মায়াবী লাগে আগে জানা ছিলোনা বর্ণের।
বর্ণের হাতে নিজের নুপুর দেখতে পেয়ে নিয়ন্তা বলে উঠলো-
এটাতো আমার নুপুর!
-হু।
-হু মানে?
-ও হ্যাঁ! এটা দেওয়ার জন্যই আপনাদের ডাকা। এখানে পড়ে থাকতে দেখলামতো।
.
বর্ণের দিকে এগিয়ে এসে নিয়ন্তা বললো-
ধন্যবাদ আপনাকে। এটা রুপোর নুপুর। আমার দাদী উপহার দিয়েছিলেন। খুঁজে না পেলে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যেতো আমার।
-শুকনো ধন্যবাদে কাজ হবেনা।
-কি করতে হবে?
-অন্য কোনোসময় দেখা হলে বলবো।
-দেখা নাও হতে পারে আর।
-হবে আমার বিশ্বাস।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে নিয়ন্তা বললো-
যেমন আজব মানুষ তেমনি আপনার আজব বিশ্বাস। গেলাম আমি।
.
.
নিয়ন্তা এগিয়ে যাচ্ছে। তার পথের দিকে চেয়ে আছে বর্ণ। কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই মেয়েটির সাথে তার আবার দেখা হবে।
.
-কিরে? দাঁড়িয়ে আছিস কেনো এভাবে?
.
বন্ধুর কথায় বর্ণ বললো-
প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া যায়, এটা বিশ্বাস করিস?
-আমিতো পড়িনি তাই জানিনা।
-আমি পড়েছি।
-কি বলিস! কবে?
-এখুনি।
-ওই মেয়ে গুলোর মাঝে কেউ?
-হু।
-কোনটা?
-কোঁকড়ানো চুল...
-কি!
-কি?
-এটা একটা মেয়ে হইলো? তার পাশের মেয়ে গুলো কতো সুন্দরী!
-সব সময় সুন্দরীর উপরে প্রেমে পড়তে হবে কথা আছে? মায়াবতীর উপরে পড়া যায়না?
-কে মায়াবতী?
-কোঁক..
-থাক। বুঝেছি। তা নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার কিছু নিয়েছিস?
-নাহ।
-কেনো!
-তার সাথে আমার আবার দেখা হবে।
-তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আর কাউকে বলিস না এসব।
.
.
.
সন্ধ্যা ৬টা...
মুফিজ সিগারেট ধরিয়ে বলল-
দোস্ত? হোটেলটা সেইরে! তোদের সিলেটে এতো ভালো হোটেল রয়েছে জানা ছিলোনা। সব কিছুই অনেক ভালো।
.
বন্ধুর কথা শুনে মুচকি হেসে বর্ণ বললো-
হুম।
-হোটেল সিলেক্ট করতে গিয়ে ভাবতে হয় হোটেলের সেবার মান ও লোকেশন নিয়ে । এই দিক থেকে তোকে আমি ১০ এ ১০দিলাম!
-তোর চাহিদা শুনেই এই হোটেল হলি গেইট এর কথাই আমার মাথায় এসেছে। এখানের এক্সক্লুসিভ এয়ারকন্ডিশনড রুমগুলো কিন্তু তোর মনের মতো হবে আমি জানতাম। তাছাড়া অতুলনীয় আতিথেয়তা এবং সর্বোচ্চ মানের সেবা হোটেলে কাটানো এক একটি রাতকে করে তুলবে প্রশান্তিময় । অতুলনীয় সার্ভিস ভ্রমণকে করবে আনন্দময় এবং উপভোগ্য। এখানে রয়েছে দক্ষ স্টাফ,সুদক্ষ ট্যুর ডেস্ক, অভিজ্ঞ ড্রাইভার, যাদের অক্লান্ত সেবায় সিলেট ভ্রমণ হয়ে উঠবে একই সঙ্গে আনন্দময় এবং সাশ্রয়ী ।
-আমার কাউকেই প্রয়োজন নেই৷ তুই থাকলেই হয়। তোর ভরসায় আমি বরিশাল থেকে এখানে এসেছি।
তুই যেভাবে বর্ণনা করেছিস তাতে আমি না এসে থাকতেই পারিনি সিলেটে।
-এখন চল।
-কোথায়?
-পাশেই হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার। দেখবিনা?
-অবশ্যই। চল।
.
.
.
মাজারে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে মোনাজাত ধরে বর্ণ।
বিড়বিড় করে সে বললো-
হে আল্লাহ, হযরত শাহজালাল (রঃ) এর উছিলায় আমার দোয়া কবুল করুন। আজ যে মেয়েটিকে আমি দেখেছি তাকে আমার জীবণসঙ্গিনী বানিয়ে দিন। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো আপনার প্রতি।
.
বন্ধু মুফিজকে নিয়ে মাজার থেকে বের হওয়ার পথে হঠাৎ সে বলে উঠলো-
এতো এতো জালালী কবুতর এখানে! নিশ্চয় খায় সবাই?
-নাহ খায়না।
-কেনো?
-তুই নিশ্চয় জানিস, ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট নগরী পূন্যভূমি হিসাবে খ্যাত। সিলেটের মাটিতে যেসব পীর, দরবেশ শায়িত আছেন এদের মধ্যে হযরত শাহজালাল (রঃ) অন্যতম।
-হুম।
-হযরত শাহজালাল (রঃ) এর আধ্যাত্নিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রঃ) তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শন স্বরুপ তিনি তাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও এর আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলের বংশধর এবং জালালী কবুতর নামে খ্যাত। সিলেটে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতর বধ করে না এবং খায় না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে।
-ওহ!
.
.
বন্ধু মুফিজের সাথে মাজার থেকে বের হতেই কোনো এক মেয়েলী কণ্ঠ শুনতে পেলো বর্ণ।
-আরে বাবা, আস্তে আস্তে সবই দেখাবো তোদের৷
-আর কি কি বাকি আছে? সংক্ষেপে বর্ণনা করনা?
.
এ কাকে দেখছে বর্ণ! চা বাগানে দেখা কোঁকাড়ানো চুলের সেই মেয়েকে! মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে সে বাকি মেয়েগুলোর সাথে।
আল্লাহ তার ডাক শুনেছে তাহলে!
মুচকি হেসে বর্ণ মুফিজকে বললো-
আমি একটু আসছি।
তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বর্ণ বললো-
সিলেট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য লীলাভূমি । এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল হাওড় হতে শুরু করে আকাশচুম্বি সবুজ পাহাড়, পাহাড় হতে নেমে আসা শান্ত শীতল পানির ঝর্না, পাহাড়ী নদীর জলে বালি পাথরের অবিরাম লুকোচুরি খেলা, ঢেউ খেলানো সবুজ চা বাগান, দেশের একমাত্র রঙিন পানির লেক সহ নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন ! কি নেই সিলেটে !
এই মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একনিমিষেই ভূবন ভুলিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট !
-সংক্ষেপেও এতো সুন্দর করে বিবরণ দেওয়া যায়!
.
খালাতো বোনকে থামিয়ে বর্ণের উদ্দেশ্যে নিয়ন্তা বললো-
-আপনি এখানে?
.
নিয়ন্তার কথা শুনে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বর্ণ বললো-
বলেছিলাম আবার দেখা হবে আমাদের।
.
নিয়ন্তাও হেসে বললো-
হুম!
-আপনার ফোন নাম্বারটা দেওয়া যাবে?
.
এমন একটা কথা বর্ণ বলে বসবে ভাবতেও পারেনি নিয়ন্তা। মাথার কাপড় সরাতে সরাতে বললো-
কি বললেন?
-ফোন নাম্বার চাইছি।
-নুপুর ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে কি এখন আপনার সাথে কথা বলতে হবে আমার? তাও ফোনে?
-আসলে...
-কি?
-আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
.
বর্ণের কথা শুনে নিয়ন্তার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বললো-
আপনার জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো আমি কাউকে ভালোবাসি কিনা।
-ওহ! আসলে আগে কারো প্রেমে পড়িনিতো।
-শিখে রাখুন তবে, এসব জিজ্ঞাসা করতে হয়। আর হ্যাঁ আমার বফ আছে। খুব তাড়াতাড়িই তার সাথে বিয়ে আমার।
.
আর কোনো কথা না বলে খালাতো বোনদের নিয়ে এগুতে থাকে নিয়ন্তা।
.
বর্ণের পাশে এসে মুফিজ বললো-
কিছু হলো?
-সে অন্য একজনকে ভালোবাসে। আমার সে হবে নারে।
.
-হতেও তো পারে!
.
কথাটি শুনে পেছনে তাকাতেই একজন মধ্যবয়সী লোক দেখতে পায় তারা।
অবাক চোখে তাকিয়ে বর্ণ জিজ্ঞাসা করলো-
কে আপনি?
.
লোকটি সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললো-
আমি রিজাউল কবির। নিয়ন্তার বাবা।
-নিয়ন্তা?
-যে মেয়েটিকে তোমার ভালো লেগেছে।
-ইয়ে মানে....
-নিয়ন্তার খালাতো বোনেরা আমাদের বাসায় ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে। আমাদের বাসা মৌলভী বাজারে। তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া। মেয়েদের তো একা ছাড়তে পারিনা। তাই আমি বললাম তোরা ঘুর, আমি তোদের পেছন পেছন থাকবো। যাতে কোনো অসুবিধে না হয়। আর এভাবেই তোমাদের কথা সব শুনেছি আমি।
-আসলে আঙ্কেল...
-বাড়ি কোথায় তোমার?
-কদমহাটা।
-এখানে কি করছো?
-বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে আসা।
-বাবা কি করেন?
-লন্ডনে থাকেন। মা আর ভাইদের নিয়ে আমিও চলে যাবো সামনের মাসে।
-বাড়ির নাম কি তোমাদের?
-জ্বী, হাকিম জমিদার বাড়ি।
-বিয়ে করবে আমার মেয়েকে?
.
কথাটি শুনে চমকে গেলো বর্ণ।
তার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রিজাউল কবির বললেন-
করবে?
.
শান্ত গলায় বর্ণ বললো-
চেয়েছিলাম কিন্তু....
-সে অন্য একজনকে ভালোবাসে। এটাই সমস্যা?
-জ্বী।
-আমিতো মানিনা।
-আপনি না মানলেও তার মনে ওই ছেলেটি রয়েছে।
-সেতো ভালো ছেলে নয়।
-মানে?
-হুম। তার বাবার থেকে আমি অনেক টাকা পাই। এসব না দেওয়ার জন্যই আমার মেয়েকে পটিয়েছে সে।
-কি বলছেন আপনি!
-বিশ্বাস না হলে যাচাই করতে পারো। আমি চাই আমার মেয়ে সুখী থাকুক। কেনো যেনো তোমার সাথেই ও সুখে থাকবে মনে হচ্ছে আমার।
-কিন্তু আপনি আমাকে কতটুকু চিনেছেন?
-চিনে নিবো। তোমার ফোন নাম্বারটা আমায় দাও।
.
নাম্বার বিনিময় হতেই নিয়ন্তা এসে বললো-
কি বাবা? তুমি উনার সাথে দাঁড়িয়ে কি করছো?
-এই ছেলে তোর পেছনে লেগেছিলো না? তাকে শায়েস্তা করছিলাম। তোরা আরো আমায় না নিয়ে ঘুরতে চেয়েছিলি।
.
রিজাউল কবিরের কথা শুনে মুচকি হাসতে থাকে বর্ণ।
নিয়ন্তা মুখ বাকিয়ে বললো-
ভাগ্যিস আমার বাবা ছিলো!
.
.
.
-এভাবে ভেজা শরীরে এখানে কেনো বসে আছো নিয়ন্তা?
.
ইরফানের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো নিয়ন্তা।
ইরফানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
ভয়ভয় কণ্ঠ নিয়ে বললো-
কে তুমি?
.
অবাক চোখে তাকিয়ে ইরফান বললো-
আমি কে মানে!
.
আর কোনো কথা না বলে ঘরের ভেতরের দিকে ছুটে যেতে থাকলো নিয়ন্তা।
.
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

মুখোশের আড়ালে - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-১৯)

কলঙ্কের ফুল - সাজি আফরোজ (সকল পর্ব ১-২৯)

রঙ চা - মাহফুজা মনিরা (সকল পর্ব ১-২৬)